নমস্কার দর্শক বন্ধুরা অমৃত কথা এই ওয়েবসাইটে আপনাদের জানাই সুস্বাগতম। ভারতীয় দর্শন শাস্ত্র এবং বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা আর্চনা এই ওয়েবসাইটের প্রধান বিষয়বস্তু ।
আজকে আপনাদের সামনে যে বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করব তা হল- পাণ্ডবরা কেন খেয়েছিলেন নিজের পিতা পান্ডুর মাংস ?
বন্ধুরা মহাভারত হিন্দু ধর্মের একটি মুখ্য ধর্মগ্রন্থ যার রচনা করেছিলেন মহর্ষি বেদব্যাস। এই মহাভারতকে পঞ্চম বেদ বলেও মনে করা হয়। এই মহাভারতে অনেক রহস্য লুকিয়ে রয়েছে - যত বেশি এই রহস্য গুলিকে জানার চেষ্টা করা হয় ততবেশি নতুন রহস্য সামনে উঠে আসে। এই রহস্য গুলির মধ্যে পান্ডু এবং তার পান্ডব পুত্রদের সাথে যুক্ত রয়েছে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ রহস্য। এই রহস্য অনুসারে সহদেব মৃত্যুর আগে নিজের পিতা পান্ডুর মাংস খেয়ে ছিলেন। হ্যাঁ বন্ধুরা, এই তথ্যটি কি আপনাকেও অবাক করে দিলো! কিন্তু, বন্ধুরা এটি সত্য সহদেব নিজের পিতার মাংস খেয়ে ছিলেন। কিন্তু তিনি এটি কেন করেছিলেন এটি জানলে আপনিও অবাক হবেন। চলুন বন্ধুরা, জেনে নেওয়া যাক সহদেব এরকমটি কেন করেছিলেন?
বন্ধুরা যেমনটা আপনারা জানতেন মহাভারতের একটি বহুচর্চিত বিষয়- পান্ডবদের পিতা রাজা পান্ডু ছিলেন। যিনি তার দুই পত্নী কুন্তি ও মাদ্রি থেকে পাঁচজন পুত্র- যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব প্রাপ্ত হয়েছিল। যারা পরবর্তীতে পঞ্চপাণ্ডব বলে পরিচিত ছিল। কিন্তু বন্ধুরা আপনারা কি জানেন এই 5 জন পুত্রের মধ্যে একটি পুত্রও বাস্তবে পান্ডুর ছিল না। এটাকে আপনারা এভাবেও বুঝতে পারেন এই 5 জন পুত্রের জন্ম রাজা পান্ডুর বীর্যের মাধ্যমে হয়নি। এটির পিছনে লুকিয়ে আছে একটি কাহিনী যে কারণে পান্ডু নিজ আপন সন্তানের সুখ প্রাপ্ত করতে পারেননি।
একদা রাজা পান্ডু তার দুই পত্নী কুন্তি ও মাদ্রির সঙ্গে শিকারে গিয়েছিলেন। সেখানে তারা দুটি হরিণ দেখতে পেলেন; যারা কিনা মৈথুনরত অবস্থায় ছিল। কিন্তু, পান্ডু ওই অবস্থাতেই হরিণের উপর তার তীর চালান। পান্ডুর চালানো ওই তীরের ফলে হরিণ দুটি আহত হয় ও তার বাস্তব রুপ ধারণ করে । যা দেখে কুন্তি ও মাদ্রিসহ পান্ডুও অবাক হয়ে যান। বাস্তবে ওই হরিণ আর কেউ না, ছিল ঋষি কিন্দম। মৃগরূপ ধারী ঋষি কিন্দমকে দেখে পান্ডু ভয় পেয়ে তার কাছে ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু ঋষি কিন্দম ক্রোধে লাল হয়ে গিয়েছিলেন এবং নিজের অন্তিম সময়ে তিনি রাজা পান্ডুকে অভিশাপ দিয়ে বলেন-
"যেইভাবে মৈথুনরত অবস্থায় তুমি আমাকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিলে, ঠিক একইভাবে যখন তুমি আমার মত এরকম মৈথুনরত অবস্থায় আসবে তখনই তোমার মৃত্যু হবে।"
এই ঘটনার পরে পান্ডুর মনে ভয় বসে গিয়েছিল। যখনই সে তার পত্নীদের সঙ্গে অথবা অন্য কোনো স্ত্রীর সঙ্গে সম্ভোগ করবেন তখনই তার মৃত্যু হয়ে যাবে। রাজা পান্ডুর মন সব সময় এই চিন্তাতেই মগ্ন থাকতো যে এখন তার বংশ কিভাবে এগিয়ে যাবে? তার বংশের কি হবে?
এই দুঃখের ফলের রাজা পান্ডু তার রাজপাঠ পরিত্যাগ করে নিজের দুই পত্নীসহ বনে গিয়ে বাস করতে থাকেন। বনে যাওয়ার পরও পান্ডুর মনের অবস্থা ঠিক ছিল না। তিনি বেশিরভাগ সময়ই অন্যমনস্ক থাকতেন। তার এরকম পরিস্থিতি দেখে কুন্তি ও মাদ্রি দুজনাই চিন্তিত থাকতেন।
পান্ডুর এরকম স্থিতি দেখে কুন্তির একদিন তার দুর্বাসা মুনির থেকে প্রাপ্ত বর বা আশীর্বাদের কথা মনে পড়ল। যেই বর দুর্বাসা মুনি কুন্তির সেবায় প্রসন্ন হয়ে তাকে দিয়েছিল। এই ঘটনাটি তখনকার যখন কুন্তি কুমারী ছিল। মহর্ষি দুর্বাসা তার মহলে অতিথি হয়ে এসেছিলেন, আর অনেকদিন পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। তখন কোনটি দুর্বাসা মুনির খুব ভালোভাবে সেবা-যত্ন করে ছিলেন। যাতে প্রসন্ন হয়ে মহর্ষি দুর্বাসা কুন্তিকে একটি বর প্রদান করেন ও তাকে একটি মন্ত্রও বলে দেন। এই মন্ত্রটি উচ্চারণ করে কুন্তি যে কোনো দেবতাকে আহ্বান করে তাকে ডাকতে পারেন, আর সন্তান প্রাপ্তি করতে পারেন।
এই বরদানের জন্যই তখন কুন্তীর একটি ভুল হয়েছিল। কুন্তী - দুর্বাসা মুনির দেওয়া ওই মন্ত্রটি যাচাই করার জন্য মন্ত্রটি একবার পাঠ করে সূর্যদেবকে আহ্বান করেছিলেন। যার ফলেই এর পরিণাম স্বরূপ সূর্যপুত্র কর্নের জন্ম হয়েছিল।
পরবর্তীতে কুন্তী রাজা পান্ডুকে এই বরদান সম্পর্কে জানালে। রাজা পান্ডু এ কথা শোনার পর প্রসন্ন হয়ে যান এবং একটুও দেরী না করে দেবতাদের আহবান করতে বলেন সেই মন্ত্রের মাধ্যমে। যার ফলস্বরূপ কুন্তীর তিন পুত্র - যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুনের জন্ম হয়। এরপর পান্ডুর আজ্ঞা পেয়ে কুন্তী এই মন্ত্রটির জ্ঞান মাদ্রিকেও দেয়। যার ফলস্বরূপ মাদ্রিও দেবতাদের আহ্বান করে দুই পুত্র - সহদেব এবং নকুলের জন্ম দেন।
এরপর সময় কাটতে থাকে এবং পান্ডুর ওই পাঁচ পুত্র অর্থাৎ যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব ধীরে ধীরে ছোট থেকে বড় হয়। পাঁচজন পুত্রই একজন আরেকজনের থেকে বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী ছিল। এই পাঁচজন পুত্রকে একত্রে হারানো খুবই কষ্টকর ছিল। যুধিষ্ঠির ধর্মবীর ছিলেন, ভীম ছিল খুবই বলবান, অর্জুন ধনুর্বিদ্যায় অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন, নকুল সৌন্দর্যের দিক থেকে সব থেকে শ্রেষ্ঠ ছিল। আর পান্ডবদের মধ্যে সবথেকে ছোট ভাই ছিল - সহদেব। এই সহদেবের উদ্দেশ্যে বলা হয় দ্বাপর যুগে সহদেবের থেকে বুদ্ধিমান আর কেউ ছিলনা। কিন্তু, এই সকল শ্রেষ্ঠ ও যোগ্য পুত্র গুলো পাওয়া সত্ত্বেও রাজা পান্ডু মন থেকে সুখী ছিলেন না। তার দুক্ষের আসল কারণ ছিল - তিনি নিজেই নিজেকে দোষী বলে ভাবতেন।
রাজা পান্ডুর মনে সব সময় এই বিষয়টি আসতে থাকে যে - ওই পাঁচজন পুত্র তার নিজের বীর্যের মাধ্যমে জন্ম নেয়নি। এই জন্য তিনি তার জ্ঞান, কৌশল ও বুদ্ধিমত্তা ওই পুত্রদের দিতে পারবেন না। এই বিষয়টি ভেবেই তিনি আপন-মনে দুঃখিত হয়ে যেতে থাকেন। মহারাজ পান্ডু চাইতেন তার নিজের মধ্যে থাকা গুণগুলি যেন তার সন্তানদের মধ্যে ফুটে ওঠে। এই জন্য তার নিজের বীর্যের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিতে হবে। আর নিজের পত্নীদের সঙ্গে সম্ভোগ না করলে এই কার্যটি সম্পন্ন হবে না। কিন্তু, ঋষি কিন্দমের অভিশাপের ফলে এটা সম্ভব নয়। এইজন্যই রাজা পান্ডু নিজেই ঠিক করেছিলেন এবং নিজে চাইতেন তার মৃত্যুর পর তার ওই পাঁচ পুত্র যেন তার মাংস ভক্ষণ করে। অর্থাৎ, বাস্তবে পঞ্চপান্ডব তাদের পিতার মাংস ভক্ষণ করার পেছনে আসল কারণ হলো- তাদের পিতা "রাজা পান্ডুর অন্তিম ইচ্ছা "।
চলুন বন্ধুরা এই সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাক - জঙ্গলের ধারে পান্ডু তার পুত্র অর্থাৎ পান্ডবদের সঙ্গে বসে কথা বলছিলেন। তখন তিনি তার পুত্রদের বলেন- হে পুত্রগন, এই 16 বছর ধরে আমি শুধুমাত্র - তোমার মাতাদের থেকে দূরে থাকিনি; এর সাথে সাথে আমি ব্রহ্মচারীর সাধনা করে অনেক অনেক অসাধারণ শক্তি এবং অনেক বুদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতা হাসিল করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু, আমি কোনো প্রভু বা গুরু নয়। সেই কারণে আমি এটা জানি না এই জ্ঞান ও বুদ্ধি গুলি তোমাদের মধ্যে আমি কিভাবে দেব । কিন্তু, এর জন্য আমার কাছে একটি উপায় আছে। যেদিন আমার মৃত্যু হবে তোমরা আমার শরীরের একটি অংশ খেয়ে নেবে। যদি তোমরা আমার শরীরের মাংস নিজেদের শরীরের একটি অংশ করে নিতে পারো তবে আমার বুদ্ধিমত্তা স্বয়ং তোমাদের কাছে পৌঁছে যাবে।
এরপর সময় কাটতে থাকে একদিন রাজা পান্ডু তার পত্নী মাদ্রির সঙ্গে বনে বিচরণ করতে থাকেন।তখন মাদ্রিকে দেখে তিনি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলেন না। এরপর যখনই রাজা সম্ভোগের পর্যায়ে পৌঁছালে তখনই ঋষি কিন্দমের অভিশাপের কারণে তার মৃত্যু হল।
এরপর পান্ডুর মৃত্যুর পরে যখন তার অগ্নিদাহ শেষ কার্য সম্পন্ন করা হচ্ছিল তখন সবাই এতো দুঃখিত ছিল যে পান্ডুর মাংস খাওয়ার কথা সবাই ভুলেই গিয়েছিল। তখনই সহদেব একটি পিঁপড়েকে পান্ডুর শরীরের এক টুকরো মাংস কে নিয়ে যেতে দেখে। যা দেখে সহদেবের তার পিতার বলা সেই কথাগুলো মনে পড়ে গেল এবং তিনি ওই পিঁপড়েটি থেকে ওই ছোট এক টুকরো মাংস টি নিয়ে খেয়ে নেয়। বন্ধুরা এই জন্য বলা হয় সহদেবের থেকে জ্ঞানী মানুষ পুরো দ্বাপর যুগে আর কেউ নেই।
সহদেব ওই মাংস টুকরো টি খাওয়ার ফলে তার অনেক বুদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিল। যে কারণে তাকে 'ত্রিকাল দর্শী' বলা হয়ে থাকে।
বন্ধুরা এর সঙ্গে সম্পর্কিত আরো দুটি কথা উঠে আসে - যার মধ্যে প্রথম কথা অনুযায়ী পঞ্চপান্ডবই রাজা পান্ডুর মাংস খেয়ে ছিলেন। কিন্তু, সবথেকে বেশি অংশ সহদেব পায়। যে কারণে সহদেবের মধ্যে তার পিতা পান্ডুর বুদ্ধিমত্তা ও গুণগুলি বেশি পরিমাণে ফুটে উঠেছিল।
দ্বিতীয় কথা অনুযায়ী শুধুমাত্র সহদেবই তার পিতা পান্ডুর মাংস খেয়েছিলেন। যার মধ্যে সহদেব তার পিতার মস্তিষ্কের তিনটি ভাগ খেয়ে ছিলেন। যার মাধ্যমে মস্তিষ্কের প্রথম টুকরোটি খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সহদেবের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হয়। দ্বিতীয় টুকরোটি হওয়ার সঙ্গে বর্তমান সম্পর্কে জ্ঞান এবং মস্তিষ্কের তৃতীয় ভাগ টি খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পুরো গান লাভ করেন সহদেব।
বন্ধুরা বলা হয়ে থাকে মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া শুধুমাত্র সহদেবই ছিলেন যিনি জানতেন মহাভারতের যুদ্ধের পরিণাম এবং কার বধ কার হাতে হবে এই সকল বিষয় সম্পর্কে। সবকিছু জানা সত্বেও ভবিষ্যতে হওয়া ঘটনা গুলি সম্পর্কে তিনি কাউকে কিছু বলতে পারতেন না। কারণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সহদেব কে অভিশাপ দিয়েছিলেন- "যখনই সহদেব তার ত্রিকাল দর্শীতার মাধ্যমে মহাভারতের যুদ্ধ সম্পর্কে কাউকে কিছু বলার চেষ্টা করবে; তখনই তার মস্তিষ্ক তিন ভাগে কেটে যাবে অর্থাৎ তার মৃত্যু হবে সেই সময়েই।" যে কারণে সবকিছু জানা সত্বেও সহদেব না জানার ভান করে ছিলেন।
আশা করি বন্ধুরা লেখাটি পড়ে আপনারা সম্মৃদ্ধ হয়েছেন। ভালো লাগলে আপনজনদের উদ্দেশ্য অবশ্যই শেয়ার করবেন। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
যদি আপনার কোনরূপ কোন প্রশ্ন থাকে কমেন্ট বক্সে অবশ্যই জানাবেন । পরবর্তী আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করে রাখবেন। এবং সকলের উদ্দেশ্যে শেয়ার করবেন।
If you have any questions or queries then comments in the comment box. To get regular updates subscribe us and please share this wisdom and knowledge.
( Please don't enter any spam link in the comment box.)
Thank You very much.
অমৃত কথা