নমস্কার দর্শক বন্ধুরা অমৃত কথা এই ওয়েবসাইটে আপনাদের জানাই সুস্বাগতম। ভারতীয় দর্শন শাস্ত্র এবং বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা আর্চনা এই ওয়েবসাইটের প্রধান বিষয়বস্তু।
বন্ধুরা পৌরাণিক কালের সবথেকে বড় যুদ্ধ মহাভারতের কুরুক্ষেত্র। যেখানে দেশ-বিদেশ ছোট-বড় রাজ্যের মধ্যে হাতে গোনা দুই একটি রাজ্য বাদে সবাই অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু তা সত্বেও অনেক এমন যোদ্ধা ছিল যারা খুব বলশালী বা শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। যার মধ্যে একজন হলেন বিদুর যার সম্পর্কে আমরা এর আগেই একটি লেখাতে আলোচনা করেছি। কিন্তু বন্ধুরা আপনারা কি জানেন এ ছাড়াও এমন একজন শক্তিশালী যোদ্ধা ছিল যে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে, তার বদলে তীর্থযাত্রায় চলে গিয়েছিল। হ্যাঁ বন্ধুরা- এখানে আমরা যার কথা বলতে চলেছি তিনি হলেন শ্রীকৃষ্ণের বড় ভাই বলরাম। নিজের বল ও ক্রোধের জন্য পরিচিত এই শক্তিশালী যোদ্ধা এমনটা কেন করল? চলুন বন্ধুরা এর উত্তর জেনে নেওয়া যাক আজকের এই লেখাটিতে।
বন্ধুরা আশাকরি আপনি এই বিষয়টি জানেন পান্ডব পুত্র ভীম এবং ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র দূর্যোধন এই দুজনের গুরু ছিলেন বলরাম। আর তিনিই এই দু'জনকে গদা চালানোর শিক্ষা দেন। বলরামের কাছে পাণ্ডব ও কৌরব দুইজনই প্রিয়পাত্র ছিল। ঠিক এই সময় যখন কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সংঘটিত হলো তখন বলরাম যেকোনো এক পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অপরপক্ষকে দুঃখী করতে চাননি। এই কারণে বলরাম শ্রীকৃষ্ণ কেও এটি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে শ্রীকৃষ্ণ যেন এই যুদ্ধে অংশ না নেয়। কারণ যুদ্ধে উপস্থিত দুই পক্ষই তাদের সম্বন্ধী বা চেনা পরিচিত। শুধু তাই নয় বলরাম দুর্যোধন কেও এটাও বচন দিয়েছিলেন যে মহাভারতের যুদ্ধে বলরাম এবং শ্রীকৃষ্ণ দুই ভাই কখনো অস্ত্র তুলবেন না। এই কারণে শ্রীকৃষ্ণ বলরামের দেওয়া কথার মান রাখতে যুদ্ধে কোনো অস্ত্র নিয়ে অংশগ্রহণ না করে অর্জুনের রথের সারথি হয়ে এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। এর সাথেই ভগবান শ্রী কৃষ্ণ বলরাম কে এটাও বুঝিয়েছিলেন যে ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য এই যুদ্ধ হওয়া দরকার। এছাড়া শ্রীকৃষ্ণ বলরাম কে আরো বলেন, আর রইল পড়ে দুই পক্ষ আমাদের চেনা পরিচিত ও সম্বন্ধি হওয়ার সেটারও একটা উপায় রয়েছে আমার কাছে। আর উপায় স্বরূপ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দুই পক্ষ অর্থাৎ পান্ডব ও কৌরবদের সামনে এই প্রস্তাব রাখেন যে তোমরা আমাকে অথবা আমার নারায়নী সেনার মধ্যে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে পারবে । তোমরা যাকে বেছে নেবে সে তোমাদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে অংশ নেবে। এর সাথে শ্রীকৃষ্ণ এই কথাটিও বললেন, এই সম্পূর্ণ যুদ্ধে আমি নাতো কোনো অস্ত্র ধারণ করব; না অস্ত্র নিয়ে কারো সঙ্গে যুদ্ধ করব। এই কথা শোনার পর কৌরব পক্ষের দূর্যোধন নারায়ণী সেনা বেছে নেন। ঠিক সেইমতই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পান্ডবদের পক্ষ নিয়ে নিরস্ত্র ভাবে যুদ্ধে অংশ নেয়। যুদ্ধের সময় কৌরবপক্ষে নারায়ণী সেনা নিয়ে ১১অক্ষসোহীনি সেনা এবং অন্যদিকে পান্ডবদের পক্ষে ৭ অক্ষসোহীনি সেনা এই যুদ্ধে অংশ নেয়। কিন্তু, তা সত্বেও বলরাম এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি এবং তিনি স্বরস্বতীর নদীটির বরাবর তীর্থ করতে বেরিয়ে পড়েন। বলরামের তীর্থে যাওয়ার আগে একটি ঘটনার বর্ণনা মহাভারতে পাওয়া যায়। যেখানে এটি উল্লেখ করা রয়েছে - যেই সময় যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল আগে থেকে, যুদ্ধের অস্ত্র শস্ত্র সঠিকভাবে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা হচ্ছিল ঠিক তখনই সেই মুহূর্তে বলরাম পান্ডবদের ছাউনিতে হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হয়। বলরাম কে পান্ডবদের ছাউনিতে আসতে দেখে শ্রীকৃষ্ণ, যুধিষ্ঠিরসহ বাকি সবাই খুব খুশি হলেন। সবাই মিলে বলরাম কে খুব আদর যত্ন করল। তারপর বলরাম সবাইকে একটু এড়িয়ে গিয়ে ধর্মরাজের কাছে গিয়ে বসলেন। ধর্মরাজের কাছে বলরাম তার মনের মধ্যে চলা - দোটানা মনের কথা খুলে বললেন। বলরাম ধর্মরাজ কে বললেন, আমি অনেকবার কৃষ্ণকে বলেছি যে আমাদের কাছে কৌরব এবং পাণ্ডব দুই পক্ষই সমান। এখন কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে বিবাদ চলছে, এই বিবাদের মধ্যে আমাদের না পড়াই ভালো। কিন্তু কৃষ্ণ আমার কোনো কথাই শুনছে না। তার অর্জুনের প্রতি স্নেহ এত বেশি সেই কারণে সে কৌরবদের বিপক্ষে রয়েছে। আর যেই পক্ষে কৃষ্ণ রয়েছে আমি তার বড় ভাই হয়ে তার বিপক্ষে যাই কি করে! আবার অন্যদিকে ভীম এবং দুর্যোধন দুজনাই আমার কাছে গদা চালানোর শিক্ষা গ্রহণ করেছে। দুজনাই আমার শিষ্য। দুজনের উপর আমার স্নেহ একই রকম। এইজন্য ভাইয়ে ভাইয়ের মধ্যে পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আমি দেখতে পারবোনা। এই কারণেই আমি তীর্থযাত্রায় চলে যাচ্ছি খুব শীঘ্রই। এই কারণেই একদিকে যখন বিশ্বের ইতিহাসে সবথেকে বড় যুদ্ধ হচ্ছিল, তখন অন্যদিকে সেই আমলের সবথেকে বড় শক্তিশালী যোদ্ধা মহাবলী বলরাম সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে তীর্থযাত্রায় চলে গিয়েছিলেন।
বলা হয় যে বলরাম যখন তীর্থযাত্রা থেকে ফিরে এলেন তখন মহাভারতের যুদ্ধ অন্তিম পর্যায়ে চলছিল এবং কুরুক্ষেত্রের ময়দানে ভীম ও দুর্যোধনের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল। এই সময়ে শ্রীকৃষ্ণের ইশারায় ভীম দুর্যোধনের উরুদেশে আঘাত করেন ও গদাযুদ্ধে তাকে পরাজিত করে। ভীমের সঙ্গে এই যুদ্ধকালীন অবস্থাতে দুর্যোধনের মৃত্যু হয়। দুর্যোধনকে এমন অবস্থায় দেখে বলরাম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে শ্রীকৃষ্ণ কে বলেন, দূর্যোধন অত্যান্ত শক্তিশালী ছিল গদাযুদ্ধে তাকে পরাজিত করা খুবই কঠিন ছিল। ছলপূর্বক এই অন্যায় করায় শুধুমাত্র দুর্যোধনকে হারানো হল না। এখানে আমার অপমানও করা হলো কেননা দুর্যোধন আমার শিষ্য ছিল। এরপর বলরাম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ভীমকে সাজা দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। তখনই শ্রীকৃষ্ণ মধ্যস্থতা বজায় রাখতে বলরাম কে এই জিনিসটি মনে করিয়ে দেন যে ধর্ম ও অধর্ম একে অপরের বিরুদ্ধে যখন যুদ্ধ হচ্ছে তখন আপনি শুরুতে এই যুদ্ধে অংশ নেন নি । এখন যখন এই যুদ্ধ অন্তিম পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে আপনার সব শেষে এসে এইভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়ে যুদ্ধের পরিণতি বা ফল কে পরিবর্তন করা উচিত নয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই কথা শোনার পর বলরাম শান্ত হলেন। কিন্তু, তার মনে এই বিষয়টি থেকেই গিয়েছিল, সে ভিতর থেকে শান্ত হতে পারছিল না। তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তখন সবার সামনে জোরে চেঁচিয়ে বলেন, রাজা দুর্যোধনকে ছলনা করে মারার ফলে পান্ডব পুত্র ভীম এই সংসারে ছলনা পূর্বক যোদ্ধা হিসেবে খ্যাত হবে। তিনি কখনো একজন সৎ ও সরল যোদ্ধা হিসেবে খ্যাতি লাভ করতে পারবেন না। কিন্তু দূর্যোধন, যে সরলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে ও ওই অবস্থাতেই মারা যায় তার সনাতন সৎগতি প্রাপ্ত হবে। এমনটা বলার পর বলরাম জি সেখান থেকে চলে যান। এই ঘটনা দুর্যোধনের প্রতি বলরামের স্নেহ স্পষ্টভাবে বুঝতে সাহায্য করে। সবশেষে শ্রীকৃষ্ণ পান্ডবদের মরতে না দিয়ে এই যুদ্ধে বিজয়ী করে তুললেন। শ্রীকৃষ্ণ একদিকে যেমন বলরামের কথার মান রাখলেন। অন্যদিকে তিনি যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করলেন। আর এটা হওয়া তো স্বাভাবিকই ছিল। কারণ যেখানে ধর্মের প্রশ্ন ওঠে সেখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে সব সময় ধর্মের পথে চলেন।
আশাকরি বন্ধুরা বলরামের মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশ না নেওয়ার কারণ টি আপনারা বুঝতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু আপনি কি জানেন শ্রীকৃষ্ণের বড় ভাই বলরামের জন্মোও এক রহস্যের মধ্যে হয়েছিল। যার জানকারি আজও বেশিরভাগ মানুষই জানেন না। পুরাণে বর্ণিত কথা অনুযায়ী বলরামের জন্ম একটি গর্ভ থেকে অন্য গর্ভে স্থানান্তরের মাধ্যমে হয়েছিল। বাস্তবে যখন দেবকি ও বাসুদেব কারাগারে বন্দী অবস্থায় ছিলেন এবং কংস এক এক করে তার সকল সন্তানদের হত্যা করে চলেছিল, তখন তার সপ্তম গর্ভজাত বালকটিকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে সর্বেশ্বর দেবের প্রেরণা পেয়ে - 'দেবী যোগমায়া' দেবকীর ওই সন্তানটিকে বাসুদেবের পত্নী রোহিনীর গর্ভে স্থানান্তরিত করে দেন। দেবকীর গর্ভে থাকা ওই সন্তান আর কেউ নন, তিনি ছিলেন বলরাম। এটাই কারণ যেই জন্য তাকে সঙ্কর্ষণ বলে ডাকা হয় অনেক সময়। বলভদ্র, হলধর, সংকর্ষণ এগুলি তার অন্যান্য নাম ছিল। এই বিষয়টি আপনারা তো জানেনই একদিকে যেমন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তার ঠান্ডা মস্তিষ্ক ও শান্ত স্বভাবের জন্য জানা যায়; অন্যদিকে বলরামকে তার বল ও ক্রোধের জন্য জানা যায়।
আশাকরি বন্ধুরা লেখাটি পড়ে আপনারা সমৃদ্ধ হয়েছেন। ভালো লাগলে আপনজনের উদ্দেশ্যে অবশ্যই শেয়ার করবেন। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। নমস্কার, ধন্যবাদ। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক।
আরো পড়ুন:- রামায়ণের যুদ্ধের পরে পবনপুত্র হনুমান কোথায় গিয়েছিলেন?CLICK HERE
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
যদি আপনার কোনরূপ কোন প্রশ্ন থাকে কমেন্ট বক্সে অবশ্যই জানাবেন । পরবর্তী আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করে রাখবেন। এবং সকলের উদ্দেশ্যে শেয়ার করবেন।
If you have any questions or queries then comments in the comment box. To get regular updates subscribe us and please share this wisdom and knowledge.
( Please don't enter any spam link in the comment box.)
Thank You very much.
অমৃত কথা