নমস্কার দর্শক বন্ধুরা অমৃত কথা এই ওয়েবসাইটে আপনাদের জানাই সুস্বাগতম। ভারতীয় দর্শন শাস্ত্র এবং বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা আর্চনা এই ওয়েবসাইটের প্রধান বিষয়বস্তু ।
আপনাদের সামনে যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব তা হল - 'লক্ষ্মীর পাঁচালী'।
বন্ধুরা মা লক্ষ্মী হলেন ধন সম্পত্তির দেবী। হিন্দু প্রতিটি ঘরে মা লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। মা লক্ষ্মীর পূজা বছরে বিভিন্ন দিন করা হয় কিন্তু তার মধ্যে একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিন হল মাঘী পূর্ণিমা তিথি। এই তিথিতে মা লক্ষ্মীর পূজা করলে মা লক্ষ্মী সন্তুষ্ট হন। বন্ধুরা মা লক্ষ্মীর পূজাতে খুব বেশি আরম্ভর এর প্রয়োজন পড়ে না। খুব অল্পতেই মা লক্ষ্মী সন্তুষ্ট হন। সেই কারণেই মা লক্ষ্মীর পূজা করলে মন থেকে ভক্তি ও শ্রদ্ধা থাকা প্রয়োজন।
বন্ধুরা আপনারা যারা মা লক্ষ্মীর পূজা করতে ইচ্ছুক তারা পূজার পর মা লক্ষ্মীর পাঁচালী অবশ্যই পাঠ করুন এতে মা লক্ষী সন্তুষ্ট হন এবং আপনার উপর মা লক্ষ্মীর কৃপা দৃষ্টি সবসময় থাকে। এছাড়াও হিন্দু প্রতিটি ঘরে বিশেষত বৃহস্পতিবারে মা লক্ষ্মীর পূজার বিধি রয়েছে। মা লক্ষ্মী বৃহস্পতিবার এ পূজার পর মা লক্ষ্মী পাঁচালী অন্তত একবার হলেও পাঠ করুন।
লক্ষ্মীর পাঁচালী
(Maa Laxmi Panchali)
দোল পূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ ।
ধীরে ধীরে বহিছে মলয় বাতাস ।।
বৈকুন্ঠেতে একাসনে লক্ষ্মী নারায়ণ ।
করিতেছেন কত কথা হইয়া মগন ।।
সৃষ্টিতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব কত কথা হয় ।
শুনিয়া আনন্দিত দেবীর হৃদয় ।।
অকস্মাৎ দেবর্ষি নারয়ান নাম স্মরে ।
আসিলেন বীনা হস্তে বৈকুন্ঠ নগরে ।।
প্রনাম করি দেবর্ষি কহেন বচন ।
মর্তে সদাই দুর্ভিক্ষ অনল ভীষন ।।
ঋষি বলে মা তুমি চঞ্চলা মন ।
সর্বদা স্থিত এভবন ও ভবন ।।
অন্নাভাবে মর্তবাসী কষ্ট পেয়ে ভোগে ।
মরিছে অনাহারে কৃশকায় রোগে ।।
ধর্মাধর্ম লোকে সবি ত্যাগ করি দেয় ।
স্ত্রী কন্যা বিক্রি করে ক্ষুধার জ্বালায় ।।
দুর্ভিক্ষে হইলো শেষ মরে মনুষ্যগণ ।
দয়া করি মা তুমি করো নিবারন ।।
নারদের বাক্য শুনি কহেন নারায়নী ।
বিশ্বমাতৃকা আমি জগৎের জননী ।।
কারো প্রতি নাই আমরা ক্রোধানল ।
ভুগিছে মর্তবাসী নিজ নিজ কর্মফল ।।
মহামায়ার স্বরূপে নারী সত্য বচন ।
মর্তবাসী না মানে এই কথন ।।
নারীর পরমগতি স্বামী ভিন্ন কেবা ।
ভুলেও না করে নারী স্বামী পদসেবা ।।
যথায় স্বেচ্ছায় ঘুরিয়া বেরায় ।
গুরুজনে অকারনে মন্দ বাক্য কয় ।।
যে নারী সকালে না দেয় ছড়া ।
করি তার সংসার আমি লক্ষ্মীছাড়া ।।
অতিথি যদি উপস্থিত হয় দ্বারে ।
দূর দূর করে বিতারিত করে তারে ।।
গুরুদেবের প্রতি ভক্তি নাহি করে ।
আমি যে থাকি না তাহার ঘরে ।।
এঁয়োতি নারী সিঁদুর না দেয় কপালে ।
মলিন বস্ত্রে যথা ইচ্ছা তথা ঘোরে ।।
নিত্য যে না করে অবগাহন ।
তারে ছাড়ি করি অন্যত্র গমন ।।
দেব দ্বিজে কদাপি ভক্তি না করে।
সকলের সাথে মত্ত সদা কলহে ।।
তিথি ভেদে নিষিদ্ধ বস্তু যে বা খায় ।
হই না কভু তার ওপর সহায় ।।
যে মনুষ্য ভক্তি ভরে একাদশী না করে।
নাহি হই প্রসন্ন তাহার ওপরে ।।
উচ্চ হাসি হাসিয়া যে নারী ঘোরে ।
ঘোমটা না টানে মস্তক উপরে ।।
গুরুজন দেখি যারা প্রনাম নাহি করে।
সন্ধ্যাকালে ধূপ দীপ নাহি জালে ঘরে ।।
এমন নারী যে গৃহেতে করে অবস্থান ।
কভু নাহি পায় তারা লক্ষ্মীর বরদান ।।
কহো নারদ কি দোষ আমার ।
জীব ভোগে কর্মদোষে তাহার ।।
ঋষি বলে মাগো তুমি জগতজননী ।
সন্তান কে করো ক্ষমা হে নারায়নী ।।
মর্তবাসীকে দাও তুমি পুনঃ বরদান ।
দূর করো মা তুমি দুর্ভিক্ষ অনাচার ।।
এত বলি বিদায় লন নারদ মুনি।
চিন্তিত হয়ে হরিকে বলেন নারায়নী ।।
কহে মাতা লক্ষ্মী দেবী প্রভু নারায়নে ।
কিরূপে দুঃখ কষ্ট যাইবে সদা দূরে ।।
লক্ষ্মীর কথা শুনি কহেন জনার্দন ।
শুন দেবী মন দিয়া আমার বচন ।।
তুমি দেবী কমলা ধনের অধিষ্ঠাত্রী ।
তোমার কৃপায় দূর হইবে অনাচ্ছিষ্টি ।।
যে জন গুরুবারে লক্ষ্মীব্রত করে ।
সুখে কাটাবে জীবন তোমার বরে ।।
জীবনান্তে আসিবে যখন তার শমন ।
অবশ্যই করিবে সে বৈকুন্ঠে গমন ।।
যাহো দেবী মর্তে করো নিজ ব্রত প্রচার ।
তোমার আশীষে দূর হইবে মহামার ।।
গমন করেন দেবী শুনি বিষ্ণুর কথা ।
পেঁচক পৃষ্ঠে মর্তে আসেন জগতমাতা ।।
অবন্তী নামক নগরী, ধারে ঘন বন ।
হেথায় আসিয়া দেবী উপস্থিত হন ।।
নগরীতে ছিল বনিক ধনেশ্বর রায় ।
অগাধ ধন- চৌদ্দ কূল যেনো বসি খায় ।।
পত্নী সুমতি, আর ছিল সাত কুমার ।
সংসার ছিল তার মা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ।।
যথাকালে ধনেশ্বর করিল স্বর্গ গমন ।
বিধবা হইলো সুমতি, ভাগ্যের লিখন ।।
সর্বদা কলহ করে সপ্ত বধূগণ ।
মারমার কাটকাট হইতো সর্বক্ষণ ।।
এইভাবে পৃথক হইলো সাত কুমার ।
সংসার রচিলো যে যার মতো যাহার ।।
সুখের সংসার হইলো ছারখার ।
লক্ষ্মী দেবী ছাড়িলেন সে সংসার ।।
এই দুঃখে বৃদ্ধা বিধবা করিতে আত্মহনন ।
আইলো একাকী নির্জন বন ।।
সেই বৃদ্ধ আপন মনে রোদোন করে ।
বিধিলিপি কেবা খন্ডাইতে পারে ।।
লক্ষ্মী দেবী শোনেন সেই ক্রন্দন ।
নিমিষে দেবী করিলেন বৃদ্ধা বেশ ধারন ।।
দেবী কহেন কে তুমি কি পরিচয় ।
কোথা হতে আসিলে কহ আমায় ।।
একে একে বুড়ী সব কহিল কথন ।
সোনার সংসার তার হইলো ছিন্নভিন্ন ।।
বুড়ী বলে মাগো অভাগা কপাল আমার ।
আসিয়াছি হেথায় আত্মহত্যা করিবার ।।
এই শুনি লক্ষ্মী দেবী বৃদ্ধারে কন ।
আত্মহত্যা মহাপাপ নরকে গমন ।।
যাও তুমি গৃহে ফিরে করো লক্ষ্মীব্রত ।
অবশ্য আসিবে সুখ পূর্বের মতো ।।
গুরুবারে সন্ধ্যাকালে মিলি এঁয়োগন ।
ব্রতের সকল কিছু করিবে আয়োজন ।।
আসন পাতি লক্ষ্মী মূর্তি তাতে বসাইবে ।
আম্রশাখা গোটা ফলে ঘট স্থাপিবে ।।
বিবিধ পুস্প, বিল্ব আর নৈবদ্য সকল ।
দিবে কলা শর্করা আর আতপ তণ্ডুল ।।
একটি করে মুদ্রা রাখিবে লক্ষ্মী ঘটে ।
এক মুষ্টি করি তণ্ডুল দিবে লক্ষ্মী সাথে ।।
আম্রশাখায় সিঁদুর তৈলে করিয়া গোলা ।
চাল বাটি লক্ষ্মী সম্মুখে দিবেক আল্পনা ।।
ধূপ দীপ জ্বালি সম্মুখে রাখিবে ।
আসন পাতি লক্ষ্মী পূজোয় বসিবে ।।
একমনে পূজিবে লক্ষ্মী নারায়ণ ।
পূজাশেষে ব্রতকথা করিবে পঠন ।।
না করিয়ো পূজায় ঘণ্টা বাদন ।
পূজান্তে উলুধ্বনি দিবে এঁয়োগন ।।
অতঃপর মহাপ্রসাদ সকলকে দিবে ।
সিঁদুর লইয়া এঁয়োগণের কপালে পরাইবে ।।
এই মতো যে জন লক্ষ্মী ব্রত করিবে ।
কোনো দুঃখ আর তার নাহি রবে ।।
শুনিয়া বৃদ্ধা কন আনন্দিত মনে ।
কে তুমি কহো পরিচয় দানে ।।
এই শুনি লক্ষ্মী দেবী নিজ মূর্তি ধরে ।
তাহা দেখি বৃদ্ধা কাঁদে হইয়া করজোড়ে ।।
করেছি মা না জেনে অনেক অপরাধ ।
ক্ষমা করি দাও মা কৃপাপ্রসাদ ।।
লক্ষ্মী কহেন যাও তুমি আপন ভবন ।
অবশ্যই পাইবে তুমি সুখ পূর্বের মতোন ।।
এত বলি বিদায় লইলেন দেবী সাগরনন্দিনী ( দেবী লক্ষ্মী রত্নাকর এর কন্যা )।
ঘরে ফিরি আসিলো ধনেশ্বর পত্নী ।।
বধূগণে ডাকি করে ব্রতের প্রচার ।
ধীরে ধীরে আসিলো বৃহস্পতিবার ।।
সপ্ত বধূ গন একত্রে লক্ষ্মী ব্রত করে ।
অনাচার চলি যায় লক্ষ্মীর বরে ।।
ধীরে ধীরে হইলো সুখের ভবন ।
যেমন ছিল পূর্বে আনন্দ মগন ।।
ধীরে ধীরে সাত সংসার এক হয়ে যায় ।
সংসার হইলো সুখের আলয় ।।
এই দেখি এক রমণী পূজা মানত করে ।
স্বামী তার চিররোগী, উপার্জন হীন সংসারে ।।
ভক্তি ভরে সেই নারী লক্ষ্মীরে পূজে ।
দেবী কৃপায় তাঁর সকল দুঃখ ঘোচে ।।
রোগ ছাড়ি স্বামী পুনঃ সুস্থ হইলো ।
এই ভাবে তার সকল দুঃখ ঘুচিলো ।।
আনন্দ দিনে এক সুন্দর পুত্র জন্মিলো ।
লক্ষ্মী কৃপায় ধন জন বৃদ্ধি পাইলো ।।
এই ভাবে লক্ষ্মী ব্রত প্রচারে দেশ দেশান্তরে ।
সকলে শুনি লক্ষ্মী ব্রত করে ।।
তাহা করি সকলের দুঃখ চলি যায় ।
কমলার কৃপা সকলের উপর বর্ষায় ।।
একদিন লক্ষ্মী পূজোয় বসে বামাগণ ।
আসিলো এক বণিক তাঁহাদের সদন ।।
বণিক কহে কোন দেবী কিবা পরিচয় ।
ইহারে করিলে পূজা কি ফল হয় ।।
বামা গন কহে ইনি দেবী নারায়নী ।
ইহার কৃপাতে সুখে বাড়ে ব্রতিনী ।।
গুরুবারে যে জন লক্ষ্মী পূজো করে ।
অবশ্যই পাইবে সুখ লক্ষ্মীর বরে ।।
এই কথা শুনে হাসে বণিক মহাশয় ।
মানিনা এই সত্য তব কথায় ।।
কপালে যদি না থাকে ধনের লিখন ।
কিরূপে দিবে লক্ষ্মী বর- ধন- জন ।।
শুধু শুধু লক্ষ্মী পূজা করি কিবা হয় ।
বৃথা কাটাইতেছো লক্ষ্মীর পূজায় ।।
গর্বে ভরা বাক্য লক্ষ্মী সইতে না পারে ।
ধীরে ধীরে দেবী তাহারে ছাড়ে ।।
ঝড় উঠি ময়ূরপঙ্খি তার জলে ডোবে ।
ধন জন আদি সব গেলো চলি ভোগে ।।
মড়কে রোগে তার ঘর হইলো ছারখার ।
ভিখারী হইয়া বণিক ঘোরে দ্বারে দ্বার ।।
এই ভাবে বহু দেশ ঘোরে সদাগর ।
একদিন আসিলো অবন্তী নগর ।।
সেই স্থানে ব্রত করে যতেক নারীগণে ।
বসি তারা মন দেয় লক্ষ্মীর ভজনে ।।
এই দেখি বণিকের হইলো স্মরণ ।
এই স্থানে দেবীরে করিছে অবমানন ।।
সেই পাপে সব ধ্বংস হইলো তাহার ।
ভূমিতে পড়ি সদাগর কান্দে বারবার ।।
ক্ষমা করি দাও মাগো কহে সদাগর ।
এই স্থানে করেছি অনেক অহঙ্কার ।।
ধনে গর্বে মত্ত হয়ে তোমাকে অবমাননা ।
সেই পাপে পাইলাম মাগো যতেক লাঞ্ছনা ।।
ক্ষুধা জ্বালায় ঘুরি দেশ দেশান্তরে ।
যতেক আত্মীয় গেলা সবে আমায় ছেড়ে ।।
এইভাবে সদাগর লক্ষ্মী স্তব করে ।
লক্ষ্মী দেবী করুণা করিল তাহারে ।।
লক্ষ্মী কৃপায় বণিক সব ফিরি পায় ।
গৃহে ফিরি মন দেয় লক্ষ্মীর পূজায় ।।
লক্ষ্মী কৃপায় সে সব ফিরি আসে।
এই ভাবে ব্রত ছড়িলো দেশে দেশে ।।
সবে মিলি শোনে লক্ষ্মীর ব্রতের কথন ।
লক্ষ্মীরে পূজে আছে যত জন ।।
প্রতি গৃহে গৃহে লক্ষ্মী পূজো হয় ।
জগতজননীর কৃপা সকলের ওপর বর্ষায় ।।
খাদ্য ধন জন বাড়ে লক্ষ্মীর কৃপায় ।
হরি হরি বল সবই তুলি হস্ত দ্বয় ।।
যেই জন ভক্তি ভরে লক্ষ্মীরে পূজিবে ।
অবশ্যই তাহার সকল দুঃখ ঘুচি যাইবে ।।
যে পড়ে ব্রত কথা আর যে করে শ্রবন ।
অবশ্য পাইবে সে লক্ষ্মী নারায়নের চরণ ।।
ব্রত কথা না শুনিও কভু হেলা মনে ।
লক্ষ্মী কৃপায় অবশ্যই বাড়িবে ধনে জনে ।।
জয় জয় ব্রহ্মময়ী, মা নারায়নী ।
তোমার কৃপায় শেষ করিনু পাঁচালী খানি।।
(সমাপ্ত)
আরো পড়ুন:- মা লক্ষ্মী ও ভগবান বিষ্ণুর বিয়ে হলো কিভাবে? - Click here
আশাকরি বন্ধুরা লেখাটি পড়ে আপনারা সম্বৃদ্ধ হয়েছেন। ভালো লাগলে আপনজনের উদ্দেশ্যে অবশ্যই শেয়ার করবেন ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। নমস্কার, ধন্যবাদ। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
যদি আপনার কোনরূপ কোন প্রশ্ন থাকে কমেন্ট বক্সে অবশ্যই জানাবেন । পরবর্তী আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করে রাখবেন। এবং সকলের উদ্দেশ্যে শেয়ার করবেন।
If you have any questions or queries then comments in the comment box. To get regular updates subscribe us and please share this wisdom and knowledge.
( Please don't enter any spam link in the comment box.)
Thank You very much.
অমৃত কথা