নমস্কার দর্শক বন্ধুরা অমৃত কথা এই ওয়েবসাইটে আপনাদের জানাই সুস্বাগতম। ভারতীয় দর্শন শাস্ত্র এবং বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা আর্চনা এই ওয়েবসাইটের প্রধান বিষয়বস্তু।
আজকে আপনাদের সঙ্গে যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব তা হল - শ্রীকৃষ্ণের কোন কথায় অর্জুন অবাক হয়ে গেলেন ?মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুন ও কর্ণের মধ্যে কে বেশি শক্তিশালী ছিল? কর্ণের ব্যক্তিত্ব কেমন ছিল?
মহাভারত হলো হিন্দুদের এবং এই বিশ্বের মধ্যে বৃহত্তম একটি গ্রন্থ। এরমধ্যে এমন অনেক কথা উল্লেখ করা হয়েছে যার মাধ্যমে আমরা বহু জ্ঞান লাভ করতে পারি। আজকের এই লেখাটিতে আপনাদের সঙ্গে এই মহাভারতেরই একটি কথা নিয়ে আলোচনা করতে চলেছি। যেখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের সঙ্গে সম্পর্কিত এমন একটি প্রসঙ্গ সম্পর্কে জানাও আজকে আপনাদের যা জানার পর আপনারা অবাক হয়ে যাবেন।
কৃষ্ণের মুখ থেকে এই কথাগুলো শোনার পর অর্জুনও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গটি হলো মহাভারতের যুদ্ধের একদম শেষ দিনের। মহাভারতের যুদ্ধের শেষ দিনের যুদ্ধে মহাদানি কর্নের বদ করার পরে যখন অর্জুন নিজের শিবিরে ফিরে এলো তখন অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, হে কেশব; কর্ণের তার নিজের ধনুর্বিদ্যা উপর খুবই অহংকার ছিল। সে সবসময় আমার সঙ্গে ধনুর্বিদ্যা তুলনা করতে চাইত। যেই কর্ণের মাথা আমাদের পঞ্চপান্ডবের সামনে কখনো নত হয়নি , সেই কর্ণকেই আজ আমি বধ করে তার সমস্ত অহংকার চুরমার করে দিলাম। অর্জুনের এই কথাগুলো শোনার পর শ্রীকৃষ্ণ একটু হাসলেন এবং বললেন , হ্যাঁ এটা সত্য ; তুমি কর্ণকে অনেকবার পরাজিত করেছো এর আগেও এবং আজ তুমি কর্ণকে বধ করেছো। কিন্তু, এর অর্থ এটা কখনোই নয় যে, কর্ণ একজন মহারথী ও শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ছিলনা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে এই সমস্ত কথা শোনার পর অর্জুন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। তখন অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, হে কেশব; আপনি কি বলতে চান আমি কি ধনুর্বিদ্যায় শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা নই?
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবারো একটু হাসলেন এবং অর্জুনকে বললেন, পিতামহ ভীষ্ম তো তোমার বানেই যুদ্ধের ময়দানে আহত হয়ে পড়েছিলেন পার্থ। তাহলে কি এর অর্থ তুমি পিতামহ ভীষ্মের থেকেও শ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদ ?
উত্তরে অর্জুন বললো - হে রাঘব, আমি কখনো পিতামহের থেকে শ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদ ছিলাম না। কিন্তু, কর্নের থেকে আমি অবশ্যই শ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদ। অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে আরও বলল - আমি এটা বুঝতে পারছি না আপনি সব সময় কেন কর্ণের পক্ষ নেন?
এরপর অর্জুন আবার বলল - হে কেশব, আপনার মনে আছে তো কুরুক্ষেত্রের ময়দানে যতবারই আমি বান চালিয়েছি কর্ণের রথের দিকে ততোবারই কর্নের রথ আমার বাণের প্রহারের ফলে দশ পা পিছু হটে যেত। যেখানে কর্নের বানের ফলে আমার রথ শুধুমাত্র দুপাই পিছনে সরে আসতো। এ থেকে কি এটা প্রমাণিত হয় না যে, আমি কর্নের থেকে শ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদ।
এরপর শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন - না পার্থ.. না, তুমি আমার সবথেকে প্রিয়। আমি তোমায় আমার দিব্যিও এবং বিরাট রূপেরও দর্শন করিয়েছি। তুমি তো আমাকে জানোই যে - আমি কে; অর্জুন বললেন - জি কেশব, আমি জানি আপনি এই তিন লোকের স্বামী। শ্রীকৃষ্ণ তখন বললেন - তাহলে পার্থ, তুমি তাবে তো এটাও জানো যে, আমি এই তিন লোকের ভার নিয়ে তোমার রথের উপর বসে ছিলাম। যেই রথ কেউ পিছিয়ে দিতে পারতো না। কিন্তু তাও কর্নের চালানো বানের প্রহারের ফলে তোমার রথ দু-পা পিছু হটে যেত। আর তুমি তার রথকে কেবলমাত্র দশ পা পেছনে সরাতে পারতে। হে পার্থ, তাহলে তুমিই নির্ণয় করো কার বানে অধিক শক্তি ছিল!
হে পার্থ, কর্ণ আসলে তোমার প্রথম শত্রু নয়। বরং 'অহংকার' হল তোমার প্রথম বড় শত্রু। এই কারণে তুমি তোমার শত্রু পক্ষকে এতটা দুর্বল ভাবছো এবং মনে করছ যে কর্ণের বধ তুমি করেছো।
এইবার অর্জুন এই কথা শোনার পর সে আরও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো এবং বলল - হে কেশব, রথ কে পিছনে সরিয়ে দেওয়ার কথাটা না হয় আমি মানছি। কিন্তু, কর্ণের বদ আমি করিনি? - এটা কেমন ধরনের কথা? উত্তরের শ্রীকৃষ্ণ বললেন- না অর্জুন! তুমি কর্নের বধ করোনি। তুমিতো কর্ণের বধের জন্য একটি মাধ্যম ছিল মাত্র। বাস্তবে কর্ণের বধ পরশুরামের অভিশাপের ফলে হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের মুখে এরকম কথা শোনার পর অর্জুন বিচলিত হয়ে পড়ল। সে কিছুই বুঝতে পারছিল না। সে তখন শ্রীকৃষ্ণ কে জিজ্ঞাসা করল - হে বাসুদেব, কেমন অভিশাপ - আমাকে বিস্তারে বলুন?
এরপর শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, যখন তোমার গুরু দ্রোণাচার্য কর্ণকে সুতপুত্র বলে বিদ্যা দান করতে মানা করে দিলেন, তখন কর্ণ ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে মহেন্দ্র পর্বতে গিয়ে পরশুরামের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শেখে। পরশুরাম শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ পুত্রদেরই শিক্ষা দান করতেন। এই কারণেই কর্ণ ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে তার কাছে গিয়ে অস্ত্র বিদ্যা শিখেছিল। কর্ণ সেখানে ধনুর্বিদ্যা সাথে সাথে আরো অন্যান্য বেশকিছু বিদ্যার শিক্ষা গ্রহণ করেছিল। একদিন কর্নের কোলের উপর মাথা রেখে তার গুরু পরশুরাম ঘুমিয়ে ছিলেন, ঠিক তখনই একটি কিট (পোকা) সেখানে এসে কর্ণকে কামড়াতে লাগলো, যার ফলে তার শরীরের উরু থেকে রক্তপাত হতে লাগলো। কিন্তু, গুরু পরশুরামের ঘুমে যাতে কোনো রকম অসুবিধা না হয় সেই কারণে সে পিরা সহ্য করতে থাকে এবং সেখানেই বসে থাকে। কিছুক্ষণ পরে গুরু পরশুরামের ঘুম ভেঙে যায় এবং তিনি ঘুম থেকে ওঠার পরেই তার নজর গিয়ে পড়ে কর্ণের উরুতে। যা দেখে পরশুরাম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে যায় এবং তিনি বলেন - কর্ণ তুমি আমার সঙ্গে ছলনা করেছো, তুমি আমার থেকে ছলনা করে বিদ্যা গ্রহণ করেছো। কেননা ক্ষত্রিয় ছাড়া কেউ কখনো এত পিরা সহ্য করে থাকতে পারে না। তুমি কখনোই ব্রাহ্মণ হতে পারো না। পশুরাম ক্রুদ্ধ হয়ে কর্ণ কে বলল - তুমি কে? কি তোমার পরিচয় - আমাকে বলো?
কর্ণ তার গুরুকে এত ক্রুদ্ধ অবস্থায় দেখে - কর্ণ তার গুরুর পায়ে মাথা নত করে বললেন, হে গুরুদেব - আমি একজন সুতপুত্র। কর্ণের এই কথা শোনার পর পরশুরাম আরো ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। তখন পরশুরাম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে কর্ণ কে অভিশাপ দেন - "যেই সময় আমার থেকে শেখা বিদ্যার তোমার সবথেকে বেশি প্রয়োজন হবে তখন সেই সময়ে তুমি সব ভুলে যাবে।"
শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, এই ছিল সেই অভিশাপ যার কারণে কর্ণের বধ করা সম্ভব হয়েছিল। আর এর থেকেও বড় সত্য হলো এই যুদ্ধ কর্ণ ইচ্ছে করেই হেরেছে। এই শুনে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, এটা কি বলছেন বাসুদেব আপনি?
তখন শ্রীকৃষ্ণ বললেন - হ্যাঁ পার্থ। তুমি জাননা, এই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় যখন কৌরব পক্ষ থেকে কর্ণকে যুদ্ধের সেনাপতি নির্বাচিত করা হল তখন আমি কর্ণকে ধর্মের পথে চলার নিমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলাম। কিন্তু, তখন সে বলল - দূর্যোধন যতই অধর্মের পথে থাকুক না কেন, দুর্যোধনের সঙ্গে মিত্রতা নেভানো তার প্রথম ধর্ম। এটাই সে মনে করত। এই কারণেই সে নিজের প্রাণ ত্যাগ করে দেবে। কিন্তু, তাও নিজের মিত্রকে কখনো ধোঁকা দেবে না। এমনটা সে আমাকে জানায়। আর সেটাই কর্ণ করেছে। অধর্মীর সঙ্গে নিজের মিত্রতাও নিভিয়েছে সে এবং নিজের প্রাণ দিয়ে ধর্মের পথ প্রশস্ত করেছে সে। এইসব কথা বলার পর শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, হে পার্থ - তুমি কর্নের ভিতরে মানসিকতা বুঝে উঠতে পারোনি। আসলে কর্ণের আত্মা ছিল এক মহান আত্মা। পার্থ - এমন ধরনের মানুষ যুগ যুগ পরে একবারই জন্ম নেয়। এই সকল মানুষ কর্ণকে এমনি দাতাকর্ণ রূপে চেনে না, আসলে সে তার মন থেকেই দানশীল ছিল। এমনকি মৃত্যুর শেষ সময়তেও সে তার দান ধর্ম পালন করেছে। পান্ডব অর্থাৎ ধর্মের পথ প্রশস্ত করার জন্য সে তার প্রাণ দান করে দেয়। হে পার্থ, যদি তুমি কোনদিনও কর্নের জীবনের পুরো সত্য জানতে পারো তাহলে তুমি স্বয়ং এই মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে তার নামে প্রণাম করবে।
তো বন্ধুরা আশাকরি মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের এই প্রসঙ্গটি পড়ে আপনারা কর্ণের ব্যক্তিত্ব কেমন ছিল সেই সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। এর পরবর্তী কোনো লেখাতে কর্ণের জন্ম সম্পর্কিত ঘটনাটি আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করব। আজকের এই লেখাটি পড়ে সমৃদ্ধ হলে আপনজনের উদ্দেশ্যে অবশ্যই শেয়ার করবেন। আজ এখানেই শেষ করলাম। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। নমস্কার, ধন্যবাদ। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক।
আরো পড়ুন:- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অনুযায়ী কোন বিষয়গুলি ঈশ্বরের উপর ছেড়ে দিতে হয় ? CLICK HERE
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
যদি আপনার কোনরূপ কোন প্রশ্ন থাকে কমেন্ট বক্সে অবশ্যই জানাবেন । পরবর্তী আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করে রাখবেন। এবং সকলের উদ্দেশ্যে শেয়ার করবেন।
If you have any questions or queries then comments in the comment box. To get regular updates subscribe us and please share this wisdom and knowledge.
( Please don't enter any spam link in the comment box.)
Thank You very much.
অমৃত কথা