নমস্কার দর্শক বন্ধুরা অমৃত কথা এই ওয়েবসাইটে আপনাদের জানাই সুস্বাগতম। ভারতীয় দর্শন শাস্ত্র এবং বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা আর্চনা এই ওয়েবসাইটের প্রধান বিষয়বস্তু ।
আজকে আপনাদের সামনে যে বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করব তা হল- জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন হলো কি করে- কৃষ্ণনগর, চন্দননগর ও বাঁকুড়া জেলার বিখ্যাত জগদ্ধাত্রী পূজা এবং নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে দেবী জগদ্ধাত্রী স্বপ্নে কি বলেছিলেন?
দুর্গাপূজা, কালীপূজা শেষ হলো; বাংলা জুড়ে এখন চলছে জগদ্ধাত্রী মার পূজা। দেবী জগদ্ধাত্রী হলেন হিন্দুদের শক্তির তথা মা দুর্গার একটি অন্যতম রূপ। হিন্দু সনাতন ধর্মে দেবী জগদ্ধাত্রীর অন্য নাম- উমা হৈমবতী। বিভিন্ন হিন্দু শাস্ত্রীয় গ্রন্থে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। যদিও দেবী জগদ্ধাত্রী আরাধনা মূলত বঙ্গদেশেই প্রচলিত। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলা চন্দননগর এবং নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পূজা খুবই জনপ্রিয়। হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে দেবী জগদ্ধাত্রীর বাৎসরিক পূজা করা হয়। প্রতিটি হিন্দু বাঙালির ধর্মীয় মানুষদের রাজসিক দেবী মা দুর্গা ও তামসিক কালীর পর স্থান হল- সত্ত্বগুণের দেবী জগদ্ধাত্রীর।
দেবী জগদ্ধাত্রী হলেন ত্রিনয়নী, চতুর্ভুজী ও সিংহবাহিনী। তার হাতে শঙ্খ, চক্র, ধনুক ও বান। তার বাহন সিংহ । এছাড়াও দেবীর নিচে সিংহের পাশে করীন্দ্রাসুর, অর্থাৎ হস্তীরূপি অসুরের মুন্ড থাকে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, জগদ্ধাত্রী দেবী করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ মহাহস্তীরূপী অসুরকে বধ করেছিলেন। এই কারণে দেবী জগদ্ধাত্রী করীন্দ্রাসুরনিসূদিনী নামে পরিচিত।দেবীর গাত্রবর্ণ উদীয়মান সূর্যের ন্যায়। জগদ্ধাত্রী পূজার নিয়ম টি একটু স্বতন্ত্র। দুটি প্রথায় এই পূজা হয়ে থাকে। কেউ কেউ সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত দুর্গাপূজার ধাঁচে জগদ্ধাত্রী পূজা করে থাকে। আবার কেউ কেউ নবমীর দিন তিনবার পূজার আয়োজন করে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী এই তিন দিনের পূজা একত্রে সেরে নেন। এই পূজার অনেক প্রথাই দুর্গাপূজার অনুরূপ।
জগদ্ধাত্রী পূজা বাঙালি হিন্দুদের একটি বিশিষ্ট উৎসব হলেও দূর্গা ও কালী পূজার তুলনায় এই জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন অপেক্ষাকৃত আধুনিককালেই ঘটে বলে মনে করা হয়। অষ্টাদশ শতকে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় তার রাজধানী কৃষ্ণনগরে এই পূজার প্রচলন করার পর, এই জগদ্ধাত্রী পূজার জনপ্রিয়তা ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পায়। তবে বাংলা জনসমাজে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আগে জগদ্ধাত্রী পূজার ব্যাপক প্রচলন ঘটেনি বলেই মনে করা হয়। যদিও দেবী জগদ্ধাত্রী বাঙালি সমাজে একান্ত অপরিচিত ছিলেন না তার প্রমাণও পাওয়া যায়। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে 'কাল- বিবেক' গ্রন্থে কার্তিক মাসে জগদ্ধাত্রী পূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়াও আরো বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়- পূর্ববঙ্গের বরিশালে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে নির্মিত একটি প্রস্তর মূর্তি পাওয়া যায়। বর্তমানে এই মূর্তিটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালার প্রত্ন বিভাগে রক্ষিত।
[কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা ও ইতিহাস]
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আগে জগদ্ধাত্রী পূজার তেমন প্রচলন ছিল না। নদীয়া জেলার সদরে জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা করেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। কিংবদন্তি অনুসারে নবাব আলীবর্দীর রাজত্বকালে মহাপদজঙ্গ ১২ লক্ষ টাকার নজরানা বা উপঢৌকন জারি করে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে। সেই নজরানা বা উপঢৌকন দিতে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র অপারক হয়, তাই তাকে বন্দী করে মুর্শিদাবাদের নিয়ে যাওয়া হয় দুর্গাপূজার কিছু সময় আগে। ফলস্বরূপ সেই বছরে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজবাড়ী যে বড় করে দূর্গা পূজার আয়োজন করা হত তা সেই বছর বন্ধ থাকে। পরবর্তীতে যখন তাকে ছাড়া হয় তখন তিনি নদীপথে তার রাজ্যে প্রবেশ করলে দেখতে পান সেখানে মা দুর্গার বিজয়ার সুর বাজছে চারিদিকে। অর্থাৎ মা দুর্গার সময় শেষ হয়ে এসেছে। চারিদিকে বিজয় দশমীর বাজনা শুনে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সেই বছরের দুর্গা পূজার কাল উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে। দূর্গা পূজার আয়োজন করতে না পেরে রাজা অত্যন্ত দুঃখিত হন। সেই রাতে মা দুর্গা রাজা কে স্বপ্নে জগদ্ধাত্রী রূপে পরবর্তী শুক্লা নবমী তিথিতে পূজা করার আদেশ দেন। এরপর থেকেই কৃষ্ণনগরে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এর উদ্যোগে ধুমধাম আকারে শুরু হয় জগদ্ধাত্রী পূজা। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা ১৭৬৬ সালে। কেউ কেউ আবার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র গিরিশচন্দ্র কে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ীর জগদ্ধাত্রী পূজার প্রবর্তক মনে করেন।
পুরানো প্রথা মেনে করা হয় জগদ্ধাত্রী পূজা। সেই কারণেই এই জগদ্ধাত্রী পূজার সময় কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির প্রধান দরজা খোলা রাখা হয়। ১৭৭২ সালে রাজবাড়ির দেখাদেখি কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়া তে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রজারা জগদ্ধাত্রী পূজা শুরু করেন। বুড়িমার নামে শুরু হওয়া এই পূজা সবার প্রথমে হয়েছিল ঘটে ও পটে। প্রথম দিকে ওই চাষাপারায় স্থানীয় গোয়ালা ও চাষের সাথে যুক্ত বেশকিছু প্রজারা তাদের জমি থেকে চাষ করা ফসলের লাভের কিছু পরিমাণ অংশ প্রত্যেকে মিলিয়ে সেই টাকা দিয়ে পুজোর প্রস্তুতি করত। এরপর প্রায় ১৭৯০ সাল নাগাদ গোবিন্দ ঘোষ ঘট-পট এর পরিবর্তে প্রতিমা পূজা করা চালু করেন। এই চাষাপাড়া বুড়িমা প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হলো প্রায় ৭৫০ ভরি সোনার অলংকারের সজ্জিত থাকেন তিনি। এছাড়াও বর্তমানে কৃষ্ণনগরে দেবী জগদ্ধাত্রী পূজা করা হয় ২০০- ও বেশি জায়গায়।
[চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা ও ইতিহাস]
চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজার প্রবর্তক ছিলেন ইন্দ্রনারায়ন চৌধুরী। শোনা যায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন ইন্দ্রনারায়ণ।নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে রাজবাড়ীর পূজা দেখে অত্যান্ত মুগ্ধ হন ইন্দ্রনারায়ন। এরপর তিনি হুগলি জেলার চন্দননগরের লক্ষীগঞ্জের চাউলপট্টির নিচু পার্টিতে জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা করেন। এটি চন্দননগরের আদি পূজা হিসেবে খ্যাত। লক্ষীগঞ্জ প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পরেই এই পূজার সূচনা করেন তিনি। ইন্দ্রনারায়ন সেই সময়ে ছিল ফরাসিদের দেওয়ান। এখনো পর্যন্ত পুরুষানুক্রমে দেওয়ান চৌধুরীদের উত্তর পুরুষের নামে পূজার সংকল্প হয়। শোনা যায় বিসর্জনের সময় আদি প্রতিমা জলে পড়লে সাপের দেখা পাওয়া যায়। স্থানীয়দের বিশ্বাস এই দেবী অত্যন্ত জাগ্রতা।
বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটিতে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সহধর্মিনী সারদা দেবীর জন্ম ভিটাতে জগদ্ধাত্রী পূজা বিশেষ জনপ্রিয়। প্রায় ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে সারদা দেবীর পিতৃগৃহে প্রথম জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা হয়। এই পূজার প্রচলন করেছিলেন তার জননী শ্যামা সুন্দরী দেবী।সারদা দেবীর পৈতৃক বাড়িতে বর্তমানে এই পূজা করার উদ্যোগ নেয় রামকৃষ্ণ মিশন। পূজা উপলক্ষে প্রচুর পরিমাণে ভক্ত সমাগম হয়।
আশাকরি এই লেখাটি পড়ে আপনারা সমৃদ্ধ হয়েছেন। ভালো লাগলে আপনজনের উদ্দেশ্যে শেয়ার করবেন অথবা আমাদের অমৃত কথাই ইউটিউব চ্যানেলটিকে ফলো করতে পারেন।
ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
নমস্কার, ধন্যবাদ ।।
ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
যদি আপনার কোনরূপ কোন প্রশ্ন থাকে কমেন্ট বক্সে অবশ্যই জানাবেন । পরবর্তী আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করে রাখবেন। এবং সকলের উদ্দেশ্যে শেয়ার করবেন।
If you have any questions or queries then comments in the comment box. To get regular updates subscribe us and please share this wisdom and knowledge.
( Please don't enter any spam link in the comment box.)
Thank You very much.
অমৃত কথা