আজকে আপনাদের সামনে যে বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করব তা হল- শনিদেবের ব্রতকথা || শনিদেবের ব্রত মাহাত্ম্য সম্পর্কে।
ব্রতের নিয়ম- শনিবার সন্ধ্যাকালে ঘরের বাইরে উঠানে এই ব্রত করিতে হয়। ইহাতে সত্যনারায়ণ পূজার ন্যায় সিন্নি দেয়া হয়। সারাদিন উপবাস থেকে সন্ধ্যায় শনিদেবের ব্রতকথা শুনে প্রসাদ গ্রহণ করবেন।
ব্রতের উপকরণ:-
১) উৎকৃষ্ট ফল ৫ টি ,
২) পান,
৩) সুপারি,
৪) কালোপার ধুতি,
৫) লোহার আসন,
৬) অঙ্গুরীয়,
৭) মধু পর্কের বাটি,
৮) মাষকলাই ,
৯) কালো তিল,
১০) নীল অপরাজিতা ফুল ,
১১) নৈবেদ্য,ধূপ, দীপ,
১২) মিষ্টান্ন
১৩) সিন্নির জন্য-আটা, দুধ, কলা,
গুড়, বাতাসা।
১৪) কালো মাটির ঘট বা লোহার ঘট,
১৫) গঙ্গাজল,
১৬) গঙ্গা মাটি,
১৭) পুষ্প প্রভৃতি।
ব্রতের ফল-
এই ব্রত করলে শনিদেব সুপ্রসন্ন হন। সংসারে আপদ বিপদ দূর হয়ে সংসার শান্তিপূর্ণ হয়। শনিদেবের কৃপায় সর্বপ্রকার গ্রহদোষ কেটে যায়।
পূজা বিধি-
আচমনাদি সমাপন করে সঙ্কল্প পূর্বক গনেশাদির পূজান্তে যথাবিধি ঘটস্থাপনাদি পূর্বক, শনিদেবের ধ্যানান্তে পূজা করিবেন।
ধ্যান মন্ত্র-
"ওঁ সৌরাষ্ট্রং কাশ্যপং শূদ্রং সূর্য্যাসাং চতুরাঙ্গলম||
কৃষ্ণং কৃষ্ণাম্বরং গৃধ্রগতং শৌরিং চতুর্ভুজম||
উদ্ববাণং শূলং ধনুহস্তং সমাহ্ণয়েৎ|| যমাধিদৈবতং দেবং প্রজাপতি প্রত্যধিদৈবতম||"
ধ্যানের সময় মূলত এই মন্ত্র পাঠ করতে হয় নিজ মনে।
পূজা মন্ত্র-
"ওঁ ঐং হ্রীং শ্রীং শনৈশ্চরায় নমঃ ||"
প্রণাম মন্ত্র-
"ওঁ নীলঞ্জনচয়ং প্রখ্যং রবিসূতঃ মহাগ্ৰহম।
ছায়ায়াং গর্ভসম্ভুতং বন্দেভক্তা শনৈশ্চরম।"
অতঃপর নবগ্ৰহ, দশদিক পাল, ছায়া, সবর্না, কালী, শিব, যম ও প্রজাপতির পূজা করার পরে শনি পূজা করবেন। শেষে ওঁ গৃধ্রের পূজা করবেন।
শনিদেবের ব্রতকথা
{শনিদেবের ব্রত মাহাত্ম্য}
একদা শ্রীহরি নামে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি নিত্য ভিক্ষা করে খেতেন এবং দিবারাত্র কৃষ্ণ নাম জপ করতেন। অন্তরে সদাই সুখী ছিলেন তিনি, কিন্তু রোজ দিন ঠিক ভাবে অন্য জুটত না পেটে।। হেনকালে তার এক পুত্র জনম নিল। পুত্রের নাম রাখলেন সুমঙ্গল। পুত্রটি ছিল অত্যন্ত মেধাবী, সবাই তার গুনগান গাইত। অল্পদিনের মধ্যে শিশুটি পুত্রটি শাস্ত্র নিয়ে জ্ঞান অর্জন করে শাস্ত্রজ্ঞ হল এবং পন্ডিত হিসেবে আখ্যা পেল সমাজে। এরপর সেই পুত্র অর্থাৎ সুমঙ্গল তার জীবনে পিতা-মাতাকে ছাড়তে চাইলো ও হঠাৎই পিতা মাতাকে ছেড়ে গৃহত্যাগ করল। গৃহ ত্যাগের বহুদিন পর সুমঙ্গল আচমকাই কোন এক জায়গায় শুনলো তার পিতা-মাতা পরলোকগমন করেছেন। সে মন থেকে অত্যন্ত ভেঙে পড়ে ওর দুঃখে জর্জরিত হয়ে যায় আপন মনে।এই কথা শোনার পর সুমঙ্গল গয়া গিয়ে পিতা-মাতার উদ্দেশ্যে পিন্ডদান করল। বাস্তবে খালি চোখে না দেখা গেলেও এসবই ছিল শনি দেবতার দৃষ্টি যার কারণে তার জীবনে দুঃখ ঘনিয়ে আসতে লাগলো।এরপর ঘুরতে ঘুরতে সুমঙ্গল বহু দূরে একটি নগরের এক রাজ সভায় এসে উপস্থিত হয়। রাজার সাথে তার বার্তালাভ হয় এবং ধীরে ধীরে রাজা তার সম্পর্কে তার থেকে জানতে পারে এবং সে তার পরিচয় দিতে থাকে। সে রাজাকে তার নাম সহ তার দুঃখজনক ঘটনা যে তার পিতা-মাতা পরলোকগমন করেছেন সমস্ত বিষয়টি বলে এবং এর সাথে এটাও বলে সে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ায়। এরপর রাজা তাকে তার সমস্ত দুঃখ দুর্দশার কথা শুনে নিজের কাছে থাকতে বলে। তারপর রাজা তাকে বললেন তোমার কথাবাত্রা এবং আচার আচরণ দেখে মনে হচ্ছে তুমি একজন শাস্ত্রজ্ঞ। শাস্ত্র পাঠ করে সভাসদগণ কে তুষ্ট করার কথা বলেন তাকে। এরপর রাজা সুমঙ্গল কে বলেন আমার দুই পুত্র আছে তাদেরকে তোমাকে শাস্ত্র বিষয়ে শিক্ষাদান করতে হবে। এই কথা শুনে সুমঙ্গল সন্তুষ্ট হইল এবং সে রাজার নিকট থাকতে রাজী হল। এরপর প্রতিদিন রাজা দুই ছেলে সুমঙ্গল এর কাছে পড়তে লাগলো। হঠাৎই পড়ুয়া বেশে একদিন শনি দেবতা এসে উপস্থিত হলেন। সুমঙ্গল তাকে চিনতে না পেরে একজন পড়ুয়া হিসেবে তাকে প্রশ্ন করে বলে তুমি এখানে কি করছ? পড়ুয়া হিসেবে শনি দেবতা উত্তর দেন শাস্ত্র সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে এসেছি।তখন সুমঙ্গল বলেন অতি যত্ন সহকারে তোমাকে আমি শাস্ত্র শেখাবো। সুমঙ্গল তার কাছে তার পরিচয় জানতে চাইল। তখন সে তার পরিচয় হিসেবে বলল শনি বলে পরিচয় কিবা দেব আর। শনৈশ্চর নাম আমার সূর্যের কুমার। এরপর সুমঙ্গল বলে সত্যিই যদি তুমি শনি হও তাহলে আমার দুঃখ কিসে দূর হবে সেটা তুমি বলে দাও। আমার উপর তোমার দৃষ্টি রয়েছে কিসে সেটি দূর হবে তুমি বলে দাও। তখন শনি দেবতা তাকে নির্দেশ দেয় ভোগকাল আর ছয় মাস বাকি আছে। মাঝে দশ জনম যাবে তা সত্ত্বেও আর ফিরে আসবেনা এই সময়, এইজন্য সপ্তম দিবসে ভাগীরথীর তীরে গিয়ে নারায়ন ভজন করো একমনে। এই বলে শনি দেবতা অন্তর্ধান হলেন বা চলে গেলেন । সুমঙ্গল আর তার দেখা পেল না। শনি দেবতার আজ্ঞামত সুমঙ্গল গঙ্গাতীরে গিয়া নারায়ণ ভজে মনস্থির করল একমনে। দশ দন্ড পূর্ণ হল- এরূপ ধারণা সুমঙ্গলের মনে, ভজন এর মাধ্যমে যাতে থাকে। কিন্তু বাস্তবতায় দশ দন্ড তখনও পূর্ণ হয়নি, সুমঙ্গল এত গভীরভাবে ভজন করতে থাকে সে আপন মনে তার পিতাকে স্মরণ করতে থাকে যে সে কী ভুলটাই না করেছে পিতা মাতাকে ছেড়ে। এমন সময় রাজার দুই পুত্র সেই নদী পাড়ে এসে উপস্থিত হয় এবং সুমঙ্গল এর ভজনে ও ধ্যানে বিপন্ন আনার চেষ্টা করে অজান্তেই, তা দেখে শনি দেবতা খুবই ক্রুদ্ধ হয় এবং শনিদেবতা সুমঙ্গল কতটা পরিমাণে গভীর ভাবে ধ্যানে মগ্ন সেটাও পরীক্ষা করার জন্য, রাজার দুই পুত্র মুণ্ড আলাদা করেন এবং সু মঙ্গলের শরীরের উপর সেটি ফেলে দেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সুমঙ্গল আপন মনে তার ভজন ও ভুল সম্পর্কে গভীরভাবে মগ্ন ছিল সে বহির্জগতের বিষয় অসচেতন ছিল। এই অবস্থায় শনি দেবতা রাজা কে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে বলেন রাজার দুই সন্তান সম্পর্কে যে তারা নদীপাড়ে খুবই বড় বিপদের মধ্যে আছেন। এই অবস্থায় রাজা দ্রুত নদী পড়ে যান তার রাজকর্মচারীদের নিয়ে তার পুত্রদের মুন্ডু ধর থেকে আলাদা দেখে রাজা মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে কান্না করতে থাকে। এইসময় রাজার লোকেরা সুমঙ্গল কে এর জন্য দায়ী করে তাকে কারাগারে বন্দী করেন। সুমঙ্গল কে কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু তা সত্বেও সুমঙ্গল ওই কারাগারে বন্দি অবস্থাতেও শনি দেবতাকে স্মরণ করেছিলেন এবং সে তার ভক্তি ও শ্রদ্ধার মাধ্যমে শনি দেবতার ভজন করতেন। এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ করে রাজায দুই পুত্র ফিরে আসে। রাজা অবাক হয় এবং তাদের দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলেন ,কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে আমার বুকের মানিক। তারা উত্তর দিল শয্যাপারে ছিনু মোরা করিয়া সায়ন। এই কথা শুনে মহারাজ আশ্চর্য হল এবং কিছুই বুঝতে পারলো না। ঠিক এই সময় রাজার সেই ব্রাহ্মণ সুমঙ্গল এর কথা মনে পড়লো যে কারাগারে বন্দি ছিল। না বুঝতে পেরে ভুলের বশে কত কষ্টই না সুমঙ্গল কে দিয়েছে মহারাজ এর আদেশে তার কর্মীরা। তাকে দ্রুত কারাগার থেকে মুক্তি করে নিয়ে আসার আদেশ দেয়া হলো। এরপর সুমঙ্গল কে রাজার সামনে নিয়ে আসার সাথে সাথেই রাজা সুমঙ্গল এর কাছে ক্ষমা চাইলেন এবং রাজা চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। এরপর রাজা সুমঙ্গল কে বললো তাহলে তখনকার মুণ্ড দর্শন করেছিলাম? সুমঙ্গল তখন উত্তর দিলেন আমি কিছু জানিনা মহারাজ ,আমি শুধু এইটুকু জানি আমি শুধু শনির দৃষ্টিতে বা শনির প্রকোপে কষ্ট পাই। এরপর রাজা বললেন যদি শনি দেবতার দর্শন পাই, তাহলে তার পা ধরে পূজো করব। এই কথা শুনে সুমঙ্গল সেখান থেকে চলে গেল। এই সমস্ত কথা শনিদেব শুনে তিনি তাঁর দর্শন দিলেন রাজা কে, শনি দেবতা কে দেখে রাজা প্রণাম করলেন এবং বললেন তোমার দর্শন যখন পেয়েছি তোমার পূজার বিধান তুমি বলে দিয়ে যাও, শনি দেবতা রাজার কথা শুনে তিনি নিজেই রাজাকে পূজার বিধান বললেন। শনি বলে পূজা বিধি শুনহে রাজন শুদ্ধভাবে শুদ্ধ মনে আমার বারেতে, করিবে আমার পূজা একান্ত মনে তে। নীল বস্ত্র কৃষ্ণতিল তৈল যে দিবে। মোষ আর মোষ কলাই সংগ্রহ করিবে। কৃষ্ণবর্ণ ঘট রাজা করিয়া স্থাপন। পঞ্চজাতি ফল ফুলে করিবে অর্পণ। এই মোর পূজাবিধি কহিলাম সার । ভক্তি মোর প্রধান যেন কি বলিব আর। পূজা শেষে ভক্তি ভরে করিবে প্রণাম। আমার প্রসাদ খাবে করিয়া যতন। সর্বপাপ দূরে যাবে আমার বচন। অভক্তি কোরিয়া প্রসাদ যে খাইবে ,অল্পদিনেই শমনের ভবনে সে যাবে। আমার পূজায় যেবা করে অনাদর। চিরকাল দুঃখ পেয়ে হইবে কাতর। এতো বলি শনি দেব হইলো অদর্শন। ভক্তিভরে করে রাজা শনির পূজন। এরই মাঝে সুমঙ্গল বিদায় লইয়া, করে সে শনির পূজা গঙ্গাতীরে গিয়া।এই মতে প্রচারিলো পূজা শনিদেবের। শনির পাঁচালী যে রাখিবে ভবনে। কখনো না সে পরে বিপদ বন্ধনে। শনিদেবের প্রনাম নিয়ে যে যায় কার্যে, সমাদর পায় সে রাজায় প্রজায়। স্কন্দপুরাণ এর কথা অন্যথা না হয়। যথারীতি ব্যাসবাক্য কভু মিথ্যা নয়। শুদ্ধাশুদ্ধ জ্ঞানহীন বলে নিবারণ। ভূমিতে লুটাইয়া বন্দি শনি চরণ।। এত দূরে এসে এই গ্রন্থ সমাপন করি। শৈনেশ্চর প্রীতে বল হরি হরি।
আরো পড়ুনঃ - শনিদেবের সাড়েসাতি দশা কি? ২০২২ কোন কোন রাশির ওপর এই সাড়েসাতির প্রভাব পড়বে?
আশাকরি ব্রতকথাটি ভাল লেগেছে। যারা শনি দেবতার ব্রত পালন করছেন পারলে তাদের উদ্দেশ্যে শেয়ার করবেন। সকলেই ভালো থাকুন এবং সুস্থ্য থাকুন, এই কামনা রেখে আজকে এখানেই শেষ করলাম। নমস্কার, ধন্যবাদ।।
ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
যদি আপনার কোনরূপ কোন প্রশ্ন থাকে কমেন্ট বক্সে অবশ্যই জানাবেন । পরবর্তী আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করে রাখবেন। এবং সকলের উদ্দেশ্যে শেয়ার করবেন।
If you have any questions or queries then comments in the comment box. To get regular updates subscribe us and please share this wisdom and knowledge.
( Please don't enter any spam link in the comment box.)
Thank You very much.
অমৃত কথা