নমস্কার দর্শক বন্ধুরা অমৃত কথা এই ওয়েবসাইটে আপনাদের জানাই সুস্বাগতম। ভারতীয় দর্শন শাস্ত্র এবং বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা আর্চনা এই ওয়েবসাইটের প্রধান বিষয়বস্তু ।
আজকে আপনাদের সামনে যে বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করব তা হল - " চার যুগের শুরু ও শেষ - কলিযুগের সমাপ্তি ও কল্কিদেবের আগমন।"
বন্ধুরা এটা আমরা সকলেই জানি হিন্দু যুগ গুলিকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই চারটি যুগ হলো - সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর এবং কলি যুগ। হিন্দু পুরাণে এই ব্যাখ্যাটিও পাওয়া যায় যে যখন কোনো যুগে সেই সময়ের পরিস্থিতি ও ধর্ম নাশ হওয়ার পর্যায়ে চলে আসে তখন ভগবান শ্রীহরি বিভিন্ন অবতারে অধর্মীদের নাশ করে তিন লোকেই অর্থাৎ স্বর্গলোক, মর্ত্যলোক ও পাতালে পুনরায় ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। এটাই হলো সেই সময় যখন নতুন একটি যুগের সূচনা হয়। বন্ধুরা আপনারা কি জানেন এই চার যুগের সূচনা কিভাবে হলো? আর যদি শেষ হতে হয়, তাহলে এই চার যুগের ধ্বংস বা অন্ত কি করে হবে?
১) সত্যযুগঃ-
বন্ধুরা হিন্দু ধর্মের সময়চক্র অনুযায়ী এই চার যুগের আগে অনেকবারই পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু, এটা মনে করা হয় - সৃষ্টির শুরুতে সবথেকে প্রথম কালখন্ডে যুগ ছিল- সত্যযুগ। সত্যযুগের কালঅব্দি ছিল ৪৮০০ আলোকবর্ষ। অর্থাৎ , ১৭ লাখ ২৮ হাজার মানব বর্ষ বলে মানা হয়। বন্ধুরা এটা মানা হয় এই যুগে মানুষের আয়ু ১ লাখ বর্ষের কাছাকাছি ছিল। এর সাথেই সত্যযুগের মানুষরা লম্বার দিক থেকে আকৃতিতে ছিল আজকের দিনের মানুষেদের তুলনায় অনেক বড়। এই যুগে মানুষের পাপের মাত্রা ছিল শূন্য; পূণ্যের মাত্রা ছিল ১০০ শতাংশ। এই যুগে ভগবান শ্রীহরি আবির্ভূত হয়েছিলেন চারটি রূপে। যথা- মৎস্য (মাছ), কূর্ম (কচ্ছপ), বরাহ (শুকর), নৃসিংহ (মানুষ ও সিংহের সমন্বিত রূপ)। কিন্তু, প্রশ্ন হল এই যুগে যখন পাপ ছিলই না তাহলে ভগবান শ্রী হরির কেন বিভিন্ন রূপ নিয়ে এই যুগে আবির্ভাব হতে হলো ?
পরম পিতা ব্রহ্মা যখন এই সত্য যুগের সৃষ্টির রচনা করেন তখন ওই সময় দেবতা, মানুষ,নাগ প্রভৃতির সঙ্গে সঙ্গে দৈত্যেরও উৎপত্তি করেছিলেন। যাতে সৃষ্টির সন্তুলন বজায় থাকে। আর এই সন্তুলন বজায় রাখতেই সত্য যুগে শ্রীহরি বিভিন্ন দৈত্যকে বধ করেছিলেন। হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী ওই সময় মানুষ জাতি তার বিকাশের জন্য অগ্রসর হচ্ছিল। অর্থাৎ মানুষ জাতি পশুর আকৃতি থেকে ধীরে ধীরে মানুষ্য আকৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। এইজন্য ভগবান শ্রীহরি শুধুমাত্র দৈত্যদের বদ করার জন্য সত্য যুগে তার চারটি রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন সেটা কিন্তু নয়; এটা মানা হয় যে সত্যযুগের শ্রী হরির আবির্ভাব হয়েছিল দৈত্য বধের পাশাপাশি তিনি মানুষ জাতির বিকাশ সাধন করেছিলেন। যে কারণে তাকে মানুষ জাতির বিকাশের প্রতীক হিসেবে মানা হয়। কিন্তু, বন্ধুরা এখানে প্রশ্ন এটাই আসে - তবে সত্য যুগের অন্ত হল কিভাবে?
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী এমনটা মানা হয় যে যখনই রাজা দশরথের ঘরে ভগবান শ্রী রামের জন্ম হলো তখনই সত্যযুগের কালঅব্দি পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। আর ভগবান শ্রী রামের জন্মের সাথেই নতুন যুগের সূচনা ঘটে। এই নতুন যুগকে বলা হয়-'ত্রেতা যুগ'।
২) ত্রেতা যুগঃ-
ত্রেতা যুগের কথা বলতে গেলে বলতে হয় এই যুগে ভগবান বিষ্ণু - বামন,পরশুরাম এবং রাম এই তিনটি রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এই যুগের কাল অব্দি ৩ হাজার ৬০০ আলোকবর্ষ। অর্থাৎ, ১২ লক্ষ ৯৬ হাজার মানব বর্ষ বলে মানা হয়। এটা মানা হয় এই যুগে মানুষের বয়স ১০ হাজার বর্ষ পর্যন্ত হত। এই যুগে পাপের পরিমাণ ছিল ২৫ শতাংশ এবং পূণ্যের পরিমাণ ছিল ৭৫ শতাংশ।
বন্ধুরা এই যুগে রাবণ, বালি, কুম্ভকর্ণ ও অহিরাবনের মত অত্যাচারীরা রাজারা বর্তমান ছিল। যারা নিজের বল ও অহংকার দ্বারা স্বর্গ- মর্ত- পাতাল এই ত্রিলোকের সমস্ত প্রাণীদের ওপর অত্যাচার করেছিলেন। যেই কারনেই এই ত্রেতাযুগে শ্রীহরি বিষ্ণুকে - রাম অবতারে জন্ম নিতে হয়। শ্রীরাম - রাবণ বধ করার পর তিনি অযোধ্যায় ফিরে আসেন এবং সেখানে বহু বছর শাসন করেন; এইভাবে কিছু বর্ষ যাবৎ রাজ্যশাসন পরিচালনা করার পর শ্রীরামও তার দেহত্যাগ করেন। বন্ধুরা হিন্দু ধর্মে এটা মানা হয় শ্রী রামের দেহ ত্যাগ করার পর আবার একটি নতুন যুগের সূচনা হয়। যে যুগটিকে আমরা 'দ্বাপর যুগ' বলে জানি।
৩) দ্বাপর যুগঃ-
দ্বাপর যুগে শ্রীহরি- 'কৃষ্ণ' রুপে জন্মগ্রহণ করেন। এই যুগের কাল অব্দি ২ হাজার ৪ শত আলোকবর্ষ। অর্থাৎ ৮ লক্ষ ৮৪ হাজার মানব বর্ষ বলে মনে করা হয়। এই যুগে মানুষের আয়ু ১ হাজার বর্ষ বলে মনে করা হতো। এই যুগে মানুষের পাপের মাত্রা ছিল ৫০ শতাংশ। এই দ্বাপর যুগকে 'যুদ্ধের যুগও' বলা হয়ে থাকে। কেননা এই যুগে ধর্ম নিয়ে অনেক যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুগে চারিদিকে অধর্ম খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পাপীদের এক এক করে নাশ করতে শুরু করেছিলেন। যখন মহাভারত যুদ্ধের শেষে সব অধর্মীদের নাশ হয়ে গেল , তখন যুধিষ্ঠির কে হস্তিনাপুরের রাজা ঘোষণা করা হলো। যখন যুধিষ্ঠির সিংহাসনে বসবে বলে রাজ তিলক সম্পন্ন হচ্ছিল তখনই গান্ধারী সেখানে এসে পৌঁছায় এবং তার সকল পুত্রের মৃত্যুর জন্য শ্রীকৃষ্ণকে দায়ী করে তাকে অভিশাপ দেন। গান্ধারী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কে অভিশাপ দিয়ে বললেন-
"হে কৃষ্ণ, যেভাবে তুমি আমার বংশ নষ্ট করলে ঠিক সেভাবেই তোমার বংশোও নষ্ট হবে।"
এরপর পাণ্ডবরা হস্তিনাপুরের ৩৬ বছর পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। এরপর গান্ধারীর দেওয়া অভিশাপের জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা নগরীর অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপ হতে লাগল। দারোকা নগরির বাসিন্দারা মদ্যপান করে একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লেন। সবশেষে অবস্থা এত খারাপ হয়ে গেল যে যদুবংশ নষ্ট হয়ে গেল। এরপরে একদিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একটি বৃক্ষের নিচে বিশ্রাম করছিলেন। সেই সময় এক শিকারী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপর ভুল করে তীর চালিয়ে দেন। যেহেতু ভগবান মৃত্যু লোকে জন্ম নিয়েছিলেন সেই অনুযায়ী এই মানষ্য রূপী শরীর থেকে তাকে এক না একদিন দূরে যেতেই হত। অতএব ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজের দেহত্যাগ করেন এবং বৈকুণ্ঠধাম ফিরে যান।এই খবর যখন যুধিষ্ঠিরের কানে গেল তখন তিনিও বুঝে গেলেন তার জীবনের উদ্দেশ্যোও সমাপ্ত হয়ে গেছে। দ্বাপর যুগ এই সময় নিজের অন্তিম পথে ছিল। আর কলিযুগের সূচনা হবে হবে করছিল। এই বিষয়টি মাথায় রেখে যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরের সিংহাসন ও রাজপাঠ পরীক্ষিত কে সপে দেয় এবং চার ভাই ও দ্রৌপদীর সঙ্গে নিজে হিমালয়ের দিকে নিজের অন্তিম যাত্রার জন্য বেরিয়ে পড়ে। এরপর ধীরে ধীরে সূচনা হয় কলিযুগের।
৪) কলিযুগঃ-
বন্ধুরা আজকে আমরা এই কলিযুগেরই অন্তর্গত। এই কলিযুগে পাপের মাত্রা ৭৫ শতাংশ এবং পূর্ণ ২৫ শতাংশ। বন্ধুরা বর্তমানে এখন কলিযুগের প্রথম ভাগ চলছে। এই যুগে মানুষের গড় আয়ু সর্বোচ্চ ১০০ বছর। এই যুগের সময়সীমা ৪ লক্ষ ৩২ হাজার বছর। এই যুগে মানুষের শরীরের দৈর্ঘ্য নিজের হাতের সাড়ে ৩ হাত। এই যুগের প্রধান তীর্থক্ষেত্র হল গঙ্গা নদী। এই যুগে পাপের মাত্রা যখন ১০০ শতাংশ হবে তখন আবারো একবার ভগবান শ্রীহরি কল্কি অবতার হিসেবে আবির্ভূত হবেন। তার স্ত্রী হবেন মাতা বৈষ্ণবীদেবী। ভগবান কল্কি জন্ম নেবেন সম্ভল নামক গ্রামে। বিষ্ণুযশ নামক ব্রাহ্মণের বাড়িতে; মাতা সুমতির গর্ভে। ভগবান শ্রী বিষ্ণু তিনি চতুর্ভুজ মূর্তি পরিত্যাগ করে মানুষ রূপে অবতারিত হবেন। কল্কি হবেন বিষ্ণুযশ ও সুমতির চতুর্থ সন্তান। বিষ্ণুযশের প্রথম তিন সন্তানের নাম হবে যথাক্রমে কবি, প্রাঞ্জ এবং সুমন্তক। মানুষের পাপের ঘড়া যখন পূর্ণ হবে তখন কল্কি যুগের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে কলিযুগের পতন শুরু হবে এবং কল্কি অবতারের হাতে সম্পূর্ণ কলিযুগের পতন হয়ে আবারও পুনরায় শুরু হবে সত্য যুগের। ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী এই যুগে দানই হবে শ্রেষ্ঠ ধর্ম এবং এই যুগে হরিনাম সংকীর্তন হবে মোক্ষ প্রাপ্তির অন্যতম উপায়। এখন দেখা যাক ভগবান কল্কি দেবের কবে আগমন ঘটে!
আশাকরি বন্ধুরা লেখাটি পড়ে আপনারা সমৃদ্ধ হয়েছেন। ভালো লাগলে আপনজনের উদ্দেশ্যে অবশ্যই শেয়ার করবেন অথবা আমাদের অমৃতকথা ইউটিউব চ্যানেলটি ফলো করতে পারেন। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
যদি আপনার কোনরূপ কোন প্রশ্ন থাকে কমেন্ট বক্সে অবশ্যই জানাবেন । পরবর্তী আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করে রাখবেন। এবং সকলের উদ্দেশ্যে শেয়ার করবেন।
If you have any questions or queries then comments in the comment box. To get regular updates subscribe us and please share this wisdom and knowledge.
( Please don't enter any spam link in the comment box.)
Thank You very much.
অমৃত কথা