বিষ্ণুভক্ত কসাইয়ের কাহিনী | কর্ম যেরকমই হোক না কেন যদি ভগবানকে স্মরণ করে করা যায় তাহলে অবশ্যই ভগবান প্রসন্ন হন | জীবন বদলে দেওয়া এক গল্প

 নমস্কার দর্শক বন্ধুরা অমৃত কথা এই ওয়েবসাইটে আপনাদের জানাই সুস্বাগতম। ভারতীয় দর্শন শাস্ত্র এবং বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা আর্চনা এই ওয়েবসাইটের প্রধান বিষয়বস্তু।   

আজকে আপনাদের সঙ্গে যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব তা হলো- কর্ম যেরকমই হোক না কেন যদি ভগবানকে স্মরণ করে করা যায় তাহলে অবশ্যই ভগবান প্রসন্ন হন।

জীবন বদলে দেওয়া এক গল্প

এই গল্পটি হল বিষ্ণুভক্ত সাদমা কসাইয়ের গল্প। একদা একটি গ্রামে সাদমা নামের একটি কসাই থাকত। সে খুবই সৎ ছিল। আর পেশায় সে একজন কসাই আর মাংস বিক্রেতা ছিল। কিন্তু তার মুখে সবসময় ভগবান বিষ্ণুর নাম থাকত। এমনকি মাংস কাটতে কাটতে ও বিক্রি করার সময়ও সে বিষ্ণু নাম গুনগুন করত। সবসময়- "নারায়ন নারায়ন- হরি হরি" - এই নাম জপ করতে থাকতো। দোকানে যেসব মানুষেরা মাংস কিনতে আসতো তারাও তাকে নিয়ে নিজেদের মধ্যেই কথা বলতো যে, কসাই হওয়া সত্ত্বেও সে সব সময় "হরি হরি" করে যাচ্ছে। 

একদিন সাদমা নিজের মতই কোথাও একটা যাচ্ছিল ঠিক তখনই তার পায়ের সাথে রাস্তায় পড়ে থাকা একটি পাথরের টুকরোর ধাক্কা লাগে। তখন সাদমা সেই পাথরটিকে দেখে এবং মনে মনে ভাবতে থাকে এই কালো রঙের গোলাকৃতি পাথর আবার কি রকম পাথর! সে তখন মনে মনে ভাবে এই পাথরটি মাংস টুকরো করার কাজে কিমবা বাটখারা হিসেবে মাংসের  ওজন করার কাজে লাগতে পারে। এইভেবে সে সেই পাথরটিকে নিজের কাছেই রেখে দেয়। তার পরদিন সকালে সে দোকান খোলে এবং দোকানে বসে এই পাথরটি দিয়েই সে মাংসের ওজনের বাটখারা হিসেবে ব্যবহার করবে বলে মনে করে। ঠিক তখনই একজন তার কাছে মাংস নিতে আসে। সেই ব্যক্তিটি তার কাছে এক কিলো মাংস চায়। তখন সেই পাথরটি দিয়ে ওজন পরিমাপ করার সময় সাদমা বুঝতে পারে পাথরটি এক কিলোগ্রাম ওজনের। এরপর আরেকজন এসে তার কাছে দুই কিলো মাংস চাই। তখন সেই পাথরটি দিয়ে পরিমাপ করার সময় সে অবাক হয়ে যায়। সে দেখে পাথরটি তখন দুই কিলোগ্রামের হয়ে গেছে। এই দেখে সে অত্যন্ত বিশমিত হয়ে পড়ে। তারপর সে মনে মনে ভাবে এই পাথরটি দিয়ে 5 কিলোগ্রাম ওজন পরিমাপ করে দেখি কি হয়!?  সে যখন 5 কিলোগ্রাম মাংস সেই পাথরটি দিয়ে পরিমাপ করে তখন সেই পাথরটি 5 কিলোগ্রাম ওজনের এসে দাঁড়ায়। এই রেখেসে অত্যান্ত চিন্তিত ও অবাক হয়ে পড়ে। আর মনে মনে ভাবতে থাকে এটা কি করে সম্ভব। তারপর সে ভাবে এই পাথরটি কোন সাধারন পাথর নয় এটি একটি - জাদুময় পাথর। তারপর ধীরে ধীরে এই কথাটি সকলের কানেকানে ছড়িয়ে গেল যে, সাদমা কসাইয়ের কাছে জাদুময় পাথর রয়েছে যা দিয়ে সে ওজন পরিমাপ করে। সে যতটা পরিমাপ চায় পাথরটি ঠিক ততটাই ওজনের হয়ে যায়। এই চমৎকার এর জন্য তার দোকানে লোকের ভিড় লেগে যায়। আর এই ভিড়ের সাথে সাথেই সাদমার দোকানের বিক্রিও বেড়ে যায়।

একদিন সাদমা ভাবতে থাকে মনে মনে- হয়তো এটা কোন জাদুকরের পাথর ছিল যা রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল, সেটাই সে পেয়েছে এবং এই জাদুই পাথরটি পাওয়ার পর তার দোকানের বিক্রি বেড়েছে, এই জন্য সে ভগবান শ্রীহরিকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আপন মনেই বলতে থাকলো "জয় শ্রী হরি"। 

একদিন সাদমার এই কথাটি সেই গ্রামের মন্দিরের পুরোহিতের কানে গেল। কিন্তু পুরোহিত সেই কসাইয়ের দোকানে যেতে রাজি হলো না। যেখানে মাংস কাটা হয় ও মাংস বিক্রি করা হয় পুরোহিত সেই অশুদ্ধ জায়গায় যেতে চাইল না। কিন্তু যখন একটি ভক্ত পুরোহিতের কাছে গিয়ে সেই চমৎকারী পাথরটি কথা বলল তখন পুরোহিত মশাই ও উৎসুক হয়ে পড়লেন সেই চমৎকারী পাথরটি দেখার জন্য। তখন তিনি ভক্তকে বললেন আমি দূর থেকেই সেই পাথরটিকে দেখব, কাছে যাব না। এরপর ওই ভক্তের সঙ্গেই পুরোহিত মশাই সাদমা কসাইয়ের দোকানের সামনে গিয়ে উপস্থিত হল। পুরোহিত মশাই দূর থেকেই সাদমা কসাইকে মাংস ওজন করতে দেখলেন। পুরোহিত মশাই দেখলেন সেই পাথরটি যতটা পরিমাণ মাংসের প্রয়োজন সেই ওজনের ভরে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছিল। 

পুরোহিত মশাই দূর থেকে সেই পাথরের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখতে লাগলেন ঠিক তখনই হঠাৎই পুরোহিত মসাই অবাক হয়ে গেলেন এবং তিনি বলে উঠলেন এটা কী করে সম্ভব। কারণ তিনি যা লক্ষ্য করেছেন সেটা পুরোই একটি অন্য বিষয়। তারপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে সেই কসাইয়ের সঙ্গে তাকে কথা বলতেই হবে। তখন পণ্ডিতমশাই সেই কসাইয়ের দোকানে গেলেন। সাদমা কসাই অবাক হয়ে গেলেন এবং পন্ডিত মশাই কে বললেন - পন্ডিত জি আপনি তাও আবার আমার এই মাংসের দোকানে! এটা কি করে সম্ভব? আপনি আমার দোকানে এসেছেন এটা দেখে আমি অত্যান্ত আশ্চর্য। তখন সাদমা কসাই কিছু না বুঝতে পেরে পন্ডিত মশাই কে বলল - আপনার কি সেবা করতে পারি বলুন? 

তখন পন্ডিত মশাই তাকে বলল - সাদমা তোমার এই চমৎকারী পাথরটি দেখার জন্যই আমি তোমার দোকানের কাছে এসেছিলাম। কিংবা তুমি এটাও বলতে পারো যে এই চমৎকারী পাথরটিই আমাকে তোমার দোকানে টেনে নিয়ে এসেছে। কিন্তু মনে হয় তুমি এই বিষয়টি থেকে সম্পূর্ণ অজানা। তুমি যেটিকে পাথর মনে করে মাংসের ওজন পরিমাপ করছো বাস্তবে সেটি শালগ্রাম শিলা বা নারায়ন মূর্তি। যা ভগবান বিষ্ণুর স্বরূপ। তুমি কি এটা জানো না - শালগ্রাম শিলা বা নারায়ন মূর্তি দিয়ে এইভাবে মাংসের ওজন পরিমাপ করা খুবই বড় পাপ।

এই শুনে সাদমা কসাই অবাক হয়ে যায়। সে বলে, কি বলছেন পন্ডিত মশাই! শালগ্রাম শিলা বা নারায়ন মূর্তি - ভগবান বিষ্ণুর স্বরূপ তাহলে তো আমি বহুৎ বড় পাপ করছি। তখন তার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে যায়। সে তার ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে থাকে এবং বলতে থাকে - শ্রী হরি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি আপনার এই রূপকে চিনতে পারিনি। তখন সাদমা কসাই পন্ডিত মশাই কে বলেন, পন্ডিত মশাই আপনি তো সব সময়ই পূজা ও সাধনার সঙ্গে যুক্ত থাকেন; তাহলে আপনার থেকে ভালো এই মূর্তিটির পূজা কেউ করতে পারবে না। কৃপা করে এই পাথরটি আপনি নিজের কাছে রেখে দিন। তখন পণ্ডিতমশাই বলেন, ঠিক আছে সাদমা। আমি ভগবান বিষ্ণুর পাথর রুপি মূর্তিকে কিভাবেই বা পূজা করতে অস্বীকার করব। তার সেবা করার সুযোগ পেয়েছি, আমি অবশ্যই তা করবো।

তারপর পণ্ডিতমশাই সেই নারায়ণ মূর্তি থেকে খুবই সাবধানতার সঙ্গে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। বাড়ি আসার পর তিনি সেই মূর্তিটি কে পূজা-অর্চনা শুরু করে দেন। পন্ডিত মশাই সেই শিলাটিকে খুবই যত্ন ও সেবা করেন। কিছুদিন পরে এক রাত্তিরে পন্ডিতমশাই যখন ঘুমিয়ে ছিলেন তখন তখন স্বপ্নে শ্রী শালগ্রাম জি আসেন। তিনি হলেন বিষ্ণু নারায়ণের স্বরূপ। তিনি পন্ডিতমশাই কে স্বপ্নে বলেন, আমি তোমার সেবায় প্রসন্ন হয়েছি। কিন্তু তুমি আমাকে ওই কসাইয়ের কাছেই রেখে এসো। তখন পণ্ডিতমশায় বললেন, হে প্রভু! আমি কি কোনো ভুল ত্রুটি করেছি আপনার পূজায়? তখন শালগ্রাম জি বলেন, তুমি আমার পূজা করো আমি এতে প্রসন্ন। কিন্তু যে ভক্ত সবসময়ই আমার নাম জপ করে তাদের কাছে আমি নিজেকে সপে দিই। সাদমা তোমার মত আমার পূজার্চনা করে না। কিন্তু, সে সবসময় আমার নাম গুনগুন করে। যা আমার খুবই ভালো লাগে, এই কারণেই তো আমি তার কাছে গিয়েছিলাম। আর যে কেউ আমার নাম সকাল-সন্ধ্যা জপ করে এবং আমাকে স্মরণ করে, আমিতো তার অধীনে থাকি। সাদমার মুখে সবসময় আমার নামই থাকে। এইজন্য আমার তাকে খুবই ভালো লাগে। সে আমার অতি প্রিয়। সাদমা আমাকে নিঃস্বার্থ ভাবে স্মরণ করে। আমি জানি তোমার মতোই সে আমার পরম ভক্ত। এই সকল কথা পণ্ডিতমশাই শোনার পর তিনি বলেন, ঠিক আছে প্রভু আমি কালকেই আপনাকে সাদমা কসাইয়ের কাছে রেখে আসবো। 

পন্ডিতমশাই তারপরের দিনই সেই কসাইয়ের দোকানে গেলেন এবং তাকে সব কথাগুলি বুঝিয়ে বললেন। পন্ডিত মশাই কসাইকে বললেন, সাদমা তুমি মহান। ভগবান বিষ্ণু তোমার কাছে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তিনি চান তার আশীর্বাদ রূপী এই শালগ্রাম শিলা তোমার কাছেই যেন থাকে। এই শুনে সাদমা কসাই আবারও অবাক হয়ে যান এবং তিনি পন্ডিত মশাই কে বলেন, সত্যি বলছেন পন্ডিত মশাই! ভগবান শ্রী বিষ্ণু এই কথা আপনাকে বলেছেন। তখন পন্ডিত মশাই তাকে বললেনঃ হ্যাঁ। তারপর সাদমা কসাই পন্ডিত মশাই কে বললেন যদি ভগবান শ্রী নারায়ন আমার এই মাংসের দোকানে থাকতে পারবেন বলে মনে করেন, তাহলে আমি কেনো তার জন্য এই সবকিছু ছেড়ে তার ভক্তিতে মগ্ন হতে পারব না। তখন থেকে সাদমা কসাই ঠিক করেন সে আর মাংস বিক্রি করবে না। সে পন্ডিত মশাই কে বলেন আমি এখন থেকে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর ভক্তিতে লিন থাকবো। আমার আজ থেকে এটাই নিয়ম ভগবান শ্রী হরির ভক্তি করা। তখন পণ্ডিতমশাই সেই নারায়ন মূর্তিটিকে সাদমা কসাইয়ের হাতে সপে দেন। তখন সাদমা কসাইয়ের চোখ দিয়ে জল ঝরতে থাকে। সে আপন মনেই মাংস বিক্রয় ও কসাইয়ের কাজ করা বন্ধ করবে বলে ঠিক করে নেয়।সেভাবে যদি আমার ঠাকুরের কীর্তন পছন্দ হয় তাহলে সে অধিক থেকে অধিকতর সময় কীর্তন করে কাটাবে। এই ভাবে এগিয়ে গিয়ে পরবর্তীতে সাদমা কসাইয়ের নাম ভগবান বিষ্ণুর পরম ভক্ত হিসেবে গণ্য করা হয়। তার এই কাহিনী ও ভক্তি তাকে চারিদিকে জনপ্রিয় করে তোলে। তিনি হয়ে ওঠেন শ্রী বিষ্ণুর পরম ভক্ত।

তো বন্ধুরা কেমন লাগলো এই সাদমা কসাইয়ের ও ভগবান বিষ্ণুর কাহিনীটি পড়ে। বন্ধুরা যদি মন সৎ থাকে ও ভগবানকে সব সময় স্মরণ করা যায় তাহলে খারাপ কর্মতেও ভগবানের শুধুমাত্র নাম জপে ভগবান প্রসন্ন হন। এই কারণে যে কোনো কর্ম করার আগে ভগবানকে অবশ্যই স্মরণ করুন। তার নাম জপের সাথে সাথে সঠিক কর্মটি করা প্রয়োজন। তাহলে ভগবান প্রসন্ন হন।

বন্ধুরা আশাকরি এই লেখাটি পড়ে আপনারা সমৃদ্ধ হয়েছেন। ভালো লাগলে আপনজনের উদ্দেশ্যে অবশ্যই শেয়ার করবেন। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। নমস্কার, ধন্যবাদ। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক।

আরো পড়ুনঃ- হিন্দু ধর্মে বিবাহের মাহাত্ম্য | স্বামী-স্ত্রীর পূর্বজন্ম সম্পর্কের রহস্য CLICK HERE