নমস্কার দর্শক বন্ধুরা অমৃত কথা এই ওয়েবসাইটে আপনাদের জানাই সুস্বাগতম। ভারতীয় দর্শন শাস্ত্র এবং বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা আর্চনা এই ওয়েবসাইটের প্রধান বিষয়বস্তু।
বন্ধুরা আপনারা নিশ্চয়ই জানেন দ্বারকা এমনই একটি ধার্মিক নগরী যা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন। হিন্দু ধর্মে এই দ্বারকা নগরীকে সপ্তম প্রাচীন নগর হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বাকি ছয়টি নগরী হল - মথুরা, কাশি, হরিদ্দার, অবন্তিকা, কাঞ্জিপুরম এবং অযোধ্যা। প্রাচীন এই নগরীর অন্য নামও ছিল। যথা- দ্বারাবতি, কুসস্তলি, আন্তরক, ওখামন্ডল, অন্দর দ্বীপ এবং বাণী দুর্গ প্রভৃতি বিভিন্ন নামে এই দ্বারকা নগরী পরিচিত ছিল। এই নগরের চারিপাশে খুব বড় বড় দেওয়াল উপস্থিত ছিল। আর যেখানে ছিল একাধিক দুয়ার। আর এই একাধিক দুয়ারের কারণেই এই নগরের নাম হয় - দ্বারকা।
বন্ধুরা, এত বড় একটি শহর কেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর পর সম্পূর্ণরূপে জলের তলে ডুবে গেল? এর পেছনের আসল কারণই-বা কি?
বন্ধুরা বর্তমানে দ্বারকা ভারতের উত্তর-পশ্চিম রাজ্য গুজরাটের একটি জেলা। হিন্দু ধর্মালম্বীদের চারটি প্রধান ধর্মীয় স্থান বা চার ধামের একটি হলো এই দ্বারকা। দ্বারকা শব্দের অর্থ হলো 'দ্বার' অর্থাৎ 'দরজা' এবং 'কা' শব্দের অর্থ হল- 'স্বর্গ বা মোক্ষ'। সেই অর্থে দ্বারকা মানে - স্বর্গের দ্বার বা মোক্ষ লাভের দুয়ার। বন্ধুরা পৌরাণিক নগরী এই দ্বারকার কথা প্রাচীন ভারত তথা হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান মহাকাব্য মহাভারত সহ ভগবদ্গীতা, স্কন্দ পুরাণ ও বিষ্ণু পুরাণে উল্লেখ রয়েছে। হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে দ্বারকা হলো সেই প্রাচীন শহর যেখানে বিষ্ণুর অষ্টম অবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বাস করতেন। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মামা ছিলেন - কংস। তিনি ছিলেন তৎকালীন মথুরার অত্যাচারী রাজা। পরবর্তী সময়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কংসকে বধ করেন। ফলে এই খবর শুনে কংসের শ্বশুর মগধের রাজা জরাসন্ধ অত্যন্ত রেগে যান। তিনি এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মথুরা আক্রমণ করেন। কিন্তু ১৭ বার মথুরার উপর আক্রমণ করা সত্ত্বেও জরাসন্ধ মথুরা জয় করতে ব্যর্থ হন। তবে এই ১৭ বার মথুরা আক্রমণের ফলে মধুরায় বসবাসকারী যাদব বংশীয়রা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন বুঝতে পারেন জরাসন্ধ আরো একবার আক্রমণ করলে তা প্রতিরোধ করা যাদবদের কাছে অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে উঠবে। তখন তিনি যাদবদের নিয়ে মথুরা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। মথুরা ত্যাগ করার পর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নতুন একটি নগরী প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করেন। তিনি তার বাহন গরুড়- এ চড়ে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের সৌরাস্তে আসেন এবং এই নতুন শহর প্রতিষ্ঠার জন্য নির্মাণের দেবতা বিশ্বকর্মার সাহায্য নেন। বিশ্বকর্মা শ্রীকৃষ্ণ কে জানান যদি সমুদ্রের দেবতা সমুদ্র দেব তাদেরকে কিছু জমি প্রদান করেন তাহলে শুধুমাত্র তবেই এই কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব। শ্রীকৃষ্ণ তখন সমুদ্র দেবের পূজা করেন। সমুদ্র দেব তখন খুশি হয়ে শ্রীকৃষ্ণ কে বারো যোজন অর্থাৎ ৭৭৩ বর্গ কিমি জমি প্রদান করেন। জমি পাবার পর বিশ্বকর্মা সেখানে দ্বারকা নগরী নির্মাণ করেন। মহাভারত অনুযায়ী এই দ্বারকা ছিল শ্রী কৃষ্ণ তথা যদুবংশীয়দের রাজধানী। খুব ভালোভাবে পরিকল্পনা করে এই দ্বারকা নগরী নির্মাণ করা হয়েছিল। পুরো শহরটি মোট ছটি ভাগে বিভক্ত ছিল। আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা এরই সঙ্গে চওড়া রাস্তা , নগর চত্বর সোনা-রুপা দামি পাথর দিয়ে নির্মিত বিশাল বিশাল প্রাসাদ , জনগণের সুযোগ সুবিধার জন্য নানা স্থাপনা ও উদ্যান প্রভৃতি ছিল এই নগরীতে। প্রায় ৭ লক্ষ ছোট বড় প্রাসাদ ছিল এই নগরীতে। এখানে ছিল "সুধর্ম সভা" নামে এক বিশাল হল ঘর। যেখানে নানা ধরনের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো। গোটা নগরীটি ছিল জল বেষ্টিত। এটি ছিল মূলত একটি দ্বীপ নগর। যার পাশে বেষ্টিত জলরাশি দ্বারকা কে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করত।
দ্বারকা নগরী ছিল দুভাগে বিভক্ত। একটি মূল দ্বারকা নগরী এবং অন্যটি দ্বিপ দারকা। বিভিন্ন তথ্যসূত্র অনুযায়ী এই দুই দ্বারকার মাঝে ছিল অগভীর সমুদ্র। মূল অংশের সঙ্গে দ্বিপ দ্বারকা নানা ব্রিজ ও বন্দর দ্বারা যুক্ত ছিল। জোয়ারের সময় দুই দ্বারকা পরস্পর পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। আবার ভাটার সময় যুক্ত হয়ে যেত এই দুটি নগরী। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মনুষ্য হিসেবে জন্মগ্রহণ করার পর তার বাকি জীবন এই দ্বারকা নগরীতেই অতিবাহিত করেছিলেন। শেষের দিকে তিনি ভালকা তীর্থের এক বোনে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দুর্ঘটনাবশত এক শিকারির তীরে নিহত হন। শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর পর গোটা দ্বারকা নগরী দুর্ভাগ্যবশত জলের তলায় ডুবে যায়।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে দ্বারকা নগরী জলের তলায় বিলীন হয়ে যাওয়ার পেছনে দুটি কারণের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথম কারণটি হল - মাতা গান্ধারীর দ্বারা দেওয়া শ্রীকৃষ্ণকে অভিশাপ এবং দ্বিতীয়টি হল - ঋষিদের দ্বারা শ্রীকৃষ্ণের পুত্র সাম্বকে দেওয়া অভিশাপ। মহাভারতের যুদ্ধের পর যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণে কৌরবদের মাতা গান্ধারীর কাছে আসেন, গান্ধারী তখন শ্রীকৃষ্ণের উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। কারণ তার শত পুত্রের মৃত্যু হয়েছে এবং তার জন্য তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দায়ী করেন। তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে অভিশাপ দেন যেভাবে কৌরব বংশের ধ্বংস হয়েছে ঠিক সেই ভাবেই একদিন যদুবংশ তলিয়ে যাবে। দ্বিতীয় ঘটনা অনুসারে মহাভারত যুদ্ধের ৩৬ বছর পরে নারদসহ যখন বিভিন্ন মুনি ঋষিরা আসেন তখন শ্রীকৃষ্ণের পুত্র সাম্ব ও তার বন্ধুবান্ধবেরা মিলে আগত মুনিঋষিদের উপহাস করেন এবং তারই সঙ্গে তাদের অশ্রদ্ধা ও অপমান করেন। আর এর ফলে ঋষিমুণিরা অভিশাপ দেন যে, দ্বারকা নগরীর প্রত্যেকটি নগরবাসীর নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে ও সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে নিজেদের বিনাশ নিজেরাই ডেকে আনবে। এরপর থেকেই দ্বারকা তে বিভিন্ন অমঙ্গলজনক ঘটনা ঘটতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ঋষিদের অভিশাপ ফলতে থাকে, দ্বারকা বাসীরা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং পরস্পরকে হত্যা করতে শুরু করে এবং তারপর গান্ধারীর অভিশাপ শেষ পর্যন্ত সত্য হয়।
শ্রীকৃষ্ণের জরা নামক ব্যাধের হাতে নিহত হওয়ার পর সমগ্র দ্বারকা জলের তলায় ডুবে যায়। বন্ধুরা দ্বারকা নগরী শুধুমাত্র গল্প কথা নয়। কারণ ২০০৫ থেকে ২০০৭ এর মধ্যে Archaeological Survey of India অর্থাৎ ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ববিদরা ডুবুরির সাহায্য নিয়ে গুজরাটের এই সমুদ্র উপকূলে সমুদ্রের গভীরে দ্বারকা নগরীর সন্ধান পেয়েছে। শুধু তাই নয় তারা ওই সময়ের বেশ কিছু বাসন পত্র এবং তারই সঙ্গে দ্বারকা নগরীর বিভিন্ন দেওয়াল ও রাজপ্রাসাদের অবশিষ্ট অংশের সন্ধান পেয়েছে। শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা অনুসারে দ্বারকা নগরীর পতনের পরেই মহাপ্রস্থানের লক্ষ্যে পান্ডবরা অগ্রসর হন এবং তারপর থেকেই দ্বাপর যুগের অবসান হয়ে কলিযুগের সূচনা হয়।
বন্ধুরা আশাকরি লেখাটি পড়ে আপনারা সমৃদ্ধ হয়েছেন। আজ এখানেই শেষ করলাম, ভালো লাগলে আপনজনের উদ্দেশ্যে অবশ্যই শেয়ার করবেন। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। নমস্কার, ধন্যবাদ।।
ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক।
আরো পড়ুন:- জেনে নিন পুরাণের ভবিষ্যৎবাণী, কতটা ভয়ানক হবে কলিযুগের অন্ত? CLICK HERE
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
যদি আপনার কোনরূপ কোন প্রশ্ন থাকে কমেন্ট বক্সে অবশ্যই জানাবেন । পরবর্তী আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করে রাখবেন। এবং সকলের উদ্দেশ্যে শেয়ার করবেন।
If you have any questions or queries then comments in the comment box. To get regular updates subscribe us and please share this wisdom and knowledge.
( Please don't enter any spam link in the comment box.)
Thank You very much.
অমৃত কথা